English

বাজেট ভাবনা : আমাদের প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

বাজেট ভাবনা : আমাদের প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
মতামত

ড. এ কে আব্দুল মোমেন

উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিগত অর্থবছর সফলতার সাথে অতিক্রম করে উন্নয়নের  ধারা অব্যাহত রেখে নতুন বছরে পা রাখতে যাচ্ছি আমরা। এরইমধ্যে নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১ জুন, ২০২৩ তারিখে মহান সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করেন। এই বাজেটের নাম দেওয়া হয়েছে ‘উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।’

বাংলাদেশকে একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন মার্কিন ক‚টনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার। সেই বাংলাদেশ এখন বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো বাজেট পাশ হয়েছে এবার। এ বাজটে ভর করে সমৃদ্ধির পথ ধরে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে এখন বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ হবে ক্ষুধা  ও দারিদ্র্যমুক্ত। যে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান হবে উন্নত। একটা সময় এদেশের মানুষ উন্নত জীবনযাপন কেমন, তা দেখার জন্য অন্য দেশের মানুষের  দিকে তাকিয়ে থাকতো। এখন দেশের মানুষ নিজেরাই সেই  জীবনযাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে। সামনে এর পরিসর আরও বাড়বে। প্রতিটি মানুষের দোড়গোড়ায় এরইমধ্যে পৌঁছে গেছে ডিজিটাল বাংলাদেশের সেবা। মানুষ এখন এমন জীবনযাপন করে, যা এক সময় কেবলই স্বপ্ন ছিল।

বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৬ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা। আরও লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এনবিআর বহির্ভূত ২০ হাজার কোটি টাকা ও কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণ থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৯০ কোটি ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা আহরণ করা হবে।

অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা, ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা সংস্থান করা হবে। চারটি মূল স্তম্ভের ওপর স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি। আমাদের অর্থনীতি এরইমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের দ্রæত বর্ধনশীল অর্থনীতির তালিকায় বাংলাদেশ এখন প্রথম কাতারে। এশিয়ার টাইগার ইকোনমি হিসেবে আমাদের মিলেছে বিশেষ পরিচিতি। বিশ্বের বহু  দেশ এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেল অনুসরণে আগ্রহী হয়ে  উঠছে। শেখ হাসিনা দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ। আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে। বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৫ শতাংশের নীচে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে। বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ।

এরই মধ্যে শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক সাক্ষরতা অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের। সবার দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাচ্ছে। অচিরেই স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেকসই নগরায়ণসহ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সব সেবা থাকবে হাতের নাগালে। তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। সব ধরনের দৈব-দুর্বিপাকে ভয়হীন, ঘুরে দাঁড়াবার ঐকান্তিক স্পৃহায় বলিয়ান, প্রত্যয়ী আর সৃজনশীল জনসাধারণই বাংলাদেশের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। যাদের বিন্দু বিন্দু ঘামের বিনিময়ে, চেষ্টায়, ত্যাগ-তিতিক্ষায় এ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে সেই কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ব্যবসায়ী, শিল্প মালিক, টেকনিশিয়ান, ড্রাইভার, মিস্ত্রী, কামার, কুমার, জেলে, বেদে, মুচি, ঋষি, ধোপা, তাঁতি, কাসারু, শাখারি, স্বর্ণকার, মাঝি, ঘরামি, কাহার, করাতি, পাতিয়ালসহ সব শ্রেণি-পেশা ও নৃগোষ্ঠীর মানুষই বাংলাদেশের সম্পদ ও প্রাণশক্তি। সবার ঐকান্তিক সহযোগিতায় শূন্য থেকে ধীরে ধীরে মহিরুহে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সব মানুষের আশা-প্রত্যাশা ও উন্নয়ন ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর প্রত্যয়ে সাজানো হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট। তবে এ বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জও কম নয়। তারপরও জাতির  জনকের কন্যা সব রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার  দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই বাজেট পাশ করেছেন এবার।

একটি কথা সকলকে মনে রাখতে হবে যে, বাজেট সরকার পেশ ও পাশ করলেও তা বাস্তবায়নে দেশবাসীর আন্তরিক সহযোগিতা অবশ্যই প্রয়োজন হবে। সকল শ্রেণি পেশার মানুষের দায়িত্ব রয়েছে এখানে। সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি এমনকি কুলি, মজদুর, শ্রমিক, কৃষক সব মানুষের ভূমিকা রয়েছে। সরকার আলাদা কোনো মহাক্ষমতাধর শক্তি নয়, যে চাইলে যে কোনো কিছু  করে ফেলতে পারবে। সরকারের শক্তি মূলত এদেশের মানুষ। অর্থনীতির মূল শক্তিও দেশের সাধারণ নাগরিক সমাজ। তারা যে ট্যাক্স প্রদান করেন, তাই  দিয়ে মূলত সরকার দেশ পরিচালনা করেন। সরকারের কাছে মানুষের  প্রত্যাশা অনেক, কিন্তু সেটা হতে হবে বাস্তবতার ভিত্তিতে। 

বাজেট কে ঘিরে কত লোকের কত প্রত্যাশা। কিন্তু সেটা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটার কথা কেউ চিন্তা করে না। এই যে, সরকারি কর্মকর্তারা ৫শতাংশ ইনক্রিমেন্ট চান, সেটার টাকা ম্যানেজ করার জন্য সরকারকে বাড়তি টাকা আয় করতে হবে। সরকার তখন বাধ্য হয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে। যেসব জিনিসপত্রের চাহিদা বেশি, সেসব জিনিসপত্রেই ট্যাক্স বসাবে। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ- মৌলিক জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে। এর ফলে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য পুরো দেশবাসীকে কষ্ট সহ্য করতে হবে। অথবা সরকার অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে আয়-ব্যয় সমন্বয় করার চেষ্টা করবে। সেখানেও সমস্যা হলো মূল্যস্ফীতি বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে তার প্রভাব পড়বে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। এজন্য সব পক্ষকে চাওয়ার সময় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। 

অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে বর্তমান বাংলাদেশের। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চিকিৎসা সব খাতেই ব্যয় বেড়েছে। দেড় কোটি জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এনে কম দামে চাল ডাল তেল দেওয়া হচ্ছে। এসব করতে বিপুল অংকের টাকা ভর্তুকি  দিতে হচ্ছে সরকারকে। এর প্রভাব পড়ছে বাকি জনগোষ্ঠীর ওপর। কাজেই বাজেটে কী চাচ্ছি, কীভাবে চাচ্ছি- সেটার গুরুত্ব বুঝে দাবি করতে হবে। কেবলমাত্র আমার বা আমাদের একটা গোষ্ঠীর জন্য পুরো দেশকে বিপদে ফেলার কোনো মানে হয় না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে রাখতে হবে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সাধারণ একজন মানুষের চেয়ে তাদের দায় ও দায়িত্ব অনেক বেশি। 

এবারের বাজেট পাশ হলো এমন একটা সময় যখন করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্ব জুড়েই মন্দা চলছে। বাংলাদেশের বাজারেও পড়েছে এর প্রভাব। সরকার না চাইলেও বেড়েছে জিনিস পত্রের দাম। ডলার সংকট, আমদানিতে কড়াকড়ি আর আইএমএফের শর্তের প্রভাবেও বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা কঠিন সময় পার করছে। এ কঠিন সময় সকলের ঐকব্যদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা উৎড়ে যাবো। এ বছরের বাজেটের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আয়। বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়, মুনাফা বা মূলধনের ওপর কর, মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক, আমদানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক- ইত্যাদি থেকে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। মাদক শুল্ক, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব, স্ট্যাম্প বিক্রয়-ইত্যাদি থেকে আয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এসব টাকা আমাদের আয় করতে হবে। দেশের মানুষই  এসব পরিশোধ করবেন। মনে রাখতে হবে সরকারের অর্থের উৎস এদেশের মানুষ। তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, তাদেরই উন্নয়নের পেছনে ব্যয় করা হয়। উন্নত দেশ বলে যেসব দেশকে আমরা চিনি, তাদের করের হার, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্যাক্স ইত্যাদি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা যদি উন্নত অর্থনীতি ও উন্নত জীবন-জীবিকা চাই, আমাদের করের আওতা অবশ্যই বর্ধিত করতে হবে। 

এবারের বাজেট, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার উপযোগী বাজেট। যেকোনো ব্যয় বাহুল্য ছেঁটে ফেলার নির্দেশনা আগেই দিয়ে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনী বছর হলেও জনতুষ্টিমূলক কোনো ব্যয় এবারের বাজেটে নেই। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থ বিবেচনা করে তিনি প্রায় সব ধরনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে এটি সরকারের শেষ বাজেট হলেও অন্যান্য নির্বাচনি বছরের বাজেটের সঙ্গে নতুন বাজেটের মিল পাওয়া যাবে না। এবারের বাজেট একান্তই দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের বাজেট। করোনা পরবর্তী সংকটে একটি বাস্তবমুখী, সময়োপযোগী এবং ব্যবসা ও বিনিয়োগ বান্ধব বাজেট এবার পাশ করেছে সরকার। দেশের সর্বস্তরের মানুষের নৈতিক দায়িত্ব হলো এ বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের সবরকম নির্দেশনা পরিপালন করা।


লেখক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। পআিইডি ফচিার