দুই বছর পর আবার হজ্জে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা। করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছর সৌদি আরবের নাগরিক ছাড়া বিদেশিদের হজ্জে অংশ নিতে দেয়নি সৌদি আরব। এবার তারা সেই সিদ্ধান্ত বদল করেছে। ২০২২ সালে (১৪৪৩ হিজরি) ১০ লাখ হজ্জ যাত্রীকে হজ্জ করতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি সরকার। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ মানুষ হজে অংশ নিয়ে থাকেন। তবে এবার বাংলাদেশ থেকে হজ্জে অংশ নিতে পারবেন ৫৭ হাজার ৫৮৫ জন। সৌদি আরবের হজ্জ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের শর্ত অনুযায়ী, হজ্জযাত্রীদের বয়স ৬৫ বছরের নিচে হতে হবে এবং করোনাভাইরাসের পূর্ণ ডোজ টিকা নেয়া থাকতে হবে। সেই সঙ্গে সৌদি আরবে রওনা হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর টেস্টের নেগেটিভ সনদ থাকতে হবে।
হজ্জ ইসলামের পাঁচ রুকনের অন্যতম একটি। যারা আর্থিক ও শারীরিক দিক থেকে সামর্থ্যবান তাদের ওপর সারা জীবনে একবার হজ্জ করা ফরজ। আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে শরিয়তের নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থান তথা বায়তুল্লাহ এবং সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ নির্ধারিত কাজের মাধ্যমে সম্পন্ন করাই ইসলামের পরিভাষায় হজ্জ।
হজ্জের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোন কিছুকে পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করার সংকল্প করা। ইসলামী শরীয়া ভাষায় কাবা শরীফ যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে ভ্রমণের ইচ্ছা বা সংকল্প করা।
হজ্জ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে পঞ্চম স্তম্ভ। মহানবী (সঃ) বলেছেন; পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। তন্মধ্যে আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা অন্যতম। (বুখারী ও মুসলিম)
হজ্জ বিত্ত্বশালী সামর্থ্যবান লোকদের জন্য একটি অন্যতম ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন, মানুষের মধ্যে যার কা'বা ঘরে যাওয়ার সামর্থ্য আছে তার জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হজ্জ করা অবশ্য কর্তব্য বা ফরজ। এতদ সত্ত্বেও যে তা অমান্য করবে সে কাফের, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি জগতের কারো মুখাপেক্ষী নন। (আল ইমরান ৯৭) এ আয়াত দ্বারা বিত্ত্ববান লোকদের উপর হজ্জ ফরজ করা হয়েছে। সুতরাং এ হজ্জকে অস্বীকার বা অমান্য করা কুফরী।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম (আ.) সর্বপ্রথম হজ্জের প্রবর্তন করেন। এর পর থেকে নবী-রসুল পরম্পরায় চলে আসছে হজ্জ পালনের বিধানটি। হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
হজ্জ প্রবর্তনের আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, কাবাঘরটি হজরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের সহায়তায় সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন। হজরত ইবরাহিম জিবরাইল (আ.)-এর সাহায্যে একই ভিতে অর্থাৎ হজরত আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত কাবার স্থানে এর পুনর্নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি নির্দেশ হলো হজ্জব্রত পালনের।
আল্লাহতায়ালা হজরত জিবরাইল (আ.) মারফত তাঁকে হজ্জের সব আহকাম সম্পর্কে অবহিত করেন। ইবরাহিম (আ.) তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করেন, চুম্বন করেন হাজরে আসওয়াদ এবং একে একে সম্পন্ন করেন হজ্জের সব আহকাম। এরপর আল্লাহর নির্দেশ এলো হজ্জের দাওয়াত বিশ্ববাসীকে পৌঁছে দেওয়ার।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, 'যখন হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে হজ্জ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেওয়া হয় তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, এটা তো জনমানবহীন প্রান্তর। এখানে ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই। যেখানে ঘনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কীভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ বললেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা দেওয়া। সারা বিশ্বে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। এ কথা শুনে হজরত ইবরাহিম (আ.) তখন মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন। আল্লাহ তা উচ্চ করে দেন।' এভাবে মক্কা পরিণত হলো হজ্জব্রত পালনের ক্ষেত্রস্থল হিসেবে। এ হজ্জ দ্বারা স্থাপিত হলো বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মহামিলনের সুন্দরতম এক দৃশ্য।
হজ্জ প্রসঙ্গে আল কোরআনে আল্লাহ তা'আলা বলেন,'আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা ঐ ব্যক্তির উপর ফরয করা হ'ল, যার এখানে আসার সামর্থ্য রয়েছে। আর যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করে (সে জেনে রাখুক যে,) আল্লাহ জগদ্বাসী থেকে মুখাপেক্ষীহীন' (আল ইমরান)।
তিনি আরো বলেন, 'আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ ও ওমরাহ পূর্ণ কর। কিন্তু যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহ'লে যা সহজলভ্য হয়, তাই কুরবানী কর' (বাক্বারাহ )। এ আয়াতটি হজ্জ ফরয হওয়ার পাশাপাশি ওমরাহ ফরয হওয়ারও দাবী রাখে, যে ব্যাপারে অধিকাংশ ছাহাবী ও ওলামায়ে কেরাম অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
নবী (সা.) একাধিক হাদিসে হজের ফজিলতের বিষয় আলোচনা করেছেন। ইবনু ওমর (রাঃ) হ'তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, 'ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপরে প্রতিষ্ঠিত (১) তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা এ মর্মে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল (২) ছালাত কায়েম করা (৩) যাকাত প্রদান করা (৪) হজ্জ সম্পাদন করা ও (৫) রামাযানের ছিয়াম পালন করা'।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ'তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ্জ হ'তে ফিরবে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন' অর্থাৎ সে কাবীরা-ছাগীরা, প্রকাশ্য-গোপনীয় সকল গুনাহ থেকে ঐরূপ মুক্ত হয়ে ফিরে আসে। যেরূপ একজন শিশু গুনাহ মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
ত্বাওয়াফ শেষে দু'রাক'আত ছালাতান্তে মাত্বাফ থেকে বেরিয়ে পাশেই যমযম কুয়া। সেখানে গিয়ে যমযমের পানি বিসমিল্লাহ বলে দাঁড়িয়ে পান করবে ও কিছুটা মাথায় দিবে। যমযমের পানি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, 'ভূপৃষ্ঠে সেরা পানি হ'ল যমযমের পানি। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য এবং রোগ মুক্তি'। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এটি বরকত মন্ডিত'।
রাসূল (সা.) আরো বলেন, 'এই পানি কোন রোগ থেকে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে পান করলে তোমাকে আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন। এটি পানের মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আল্লাহ তোমাকে আশ্রয় দিবেন। আর তুমি এটা পরিতৃপ্তি বা পিপাসা মিটানোর জন্য পান করলে আল্লাহ সেটিই করবেন'।
হজ্জ হচ্ছে গোটা মুসলিম মিল্লাতের মহাঐক্যের সম্মেলন, যাতে সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানদের রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও ভৌগোলিক সীমারেখার বিভিন্নতা ভুলে এককেন্দ্রিক হওয়ার পথ খুঁজে পায়। এর মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের চিত্র ফুটে ওঠে। এটি মুসলমানদের মধ্যে ইমানি জজবা ও ইসলামী চেতনা সৃষ্টি করে।
আরাফার মরুপ্রান্তরে প্রায় সোয়া লাখ জনতার সমাবেশে ৯ জিলহজ, ১০ হিজরি সালে জুমাবার দ্বিপ্রহরের খানিক পরে সিক্ত ভক্তদের উদ্দীপ্ত প্রেরণা ও ধীর আগ্রহের প্রহর শেষে হজরত মুহাম্মদ (সা.) যে ভাষণ দেন, ইসলামের ইতিহাসে সেটাই 'বিদায় হজ্জের ভাষণ' নামে ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত আগত, বিগত পৃথিবীর সব ভাষণের মধ্যে এ ভাষণ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিভূষিত। বিশ্ব মানবতার মুক্তির এমন কোনো দিক নেই, যার ছোঁয়া এই মূল্যবান ভাষণে লাগেনি। মূলত বিদায় হজ্জের ভাষণ মহানবী (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস। তা ছাড়া এ ভাষণ ছিল মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর থেকে কিয়ামত অবধি বিপদসংকুল পৃথিবীর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান। এ ভাষণ ছিল বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার এক পূর্ণাঙ্গ ও বাস্তব কর্মসূচি। ইসলাম ধর্মের ক্রমসম্প্রসারমাণ প্রক্রিয়া ও রূপরেখার যে ধারাবাহিকতা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়েছিল, তারই পূর্ণ বিকাশ ও পরিসমাপ্তি ঘটেছিল এ ভাষণের মধ্য দিয়ে। এ ভাষণের পর তিন মাস অতিবাহিত হতে না হতেই তিনি এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অবিনশ্বর জগতে পাড়ি জমান। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি লাখো জনতার কণ্ঠে নবুয়তি দায়িত্ব যথার্থভাবে পালনের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন। রাসুল (সা.)-এর মুখে 'আল-বিদা', 'আল-বিদা' ধ্বনি শুনে ভক্তকুলের আকাশ বিদীর্ণ করা আর্তনাদ ও নিঃশব্দ আকুতিতে সেদিন ভারী হয়েছিল আরাফার আকাশ। 'আমি কি পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি?' বারবার ধ্বনিত হওয়া এ বাক্যটি শুনে বিগলিত মন ও সিক্ত নয়নে ভক্তকুলের মুখ থেকে কেবল একটি শব্দই বেরিয়ে এসেছিল, 'নায়াম'- হ্যাঁ। ইসলামের পূর্ণতা এসেছিল এ বিদায় হজ্জের ভাষণের মধ্য দিয়ে।
সুতরাং হজ্জ হচ্ছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ঐক্যসম্মিলন, অন্য কোনো কারণে এত অধিক সংখ্যক মুসলমান কখনও একত্রিত হয় না। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) আরবের মরু প্রান্তরে শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠায় কত কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা বাস্তবে অনুধাবন করা মুসলিম উম্মাহর একটি বড় দায়িত্ব ও শিক্ষা এবং সেটি হজ্জ পালনের সময় অনুভব করা যায়। হজ্জ কেবল ঈমানকে বলিষ্ঠ করে না, বরং এটা সমগ্র মুসলিম জাহানকে ঐক্যবদ্ধ করার পন্থা হিসেবেও কাজ করে। হজ্জের সময় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মিল, দৃষ্টিভঙ্গির মিল—এই প্রত্যেকটি জিনিসই মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ উন্নয়নে সাহায্য করে। বিশ্বের সব এলাকার, সব বর্ণের, সব ভাষার এবং প্রশিক্ষণ ভৌগোলিক জ্ঞানের সীমা সম্প্রসারিত করে জাতীয়তার প্রাচীরকে করে নিশ্চিহ্ন, সৃষ্টি করে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এ নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। হজ্জ বিশ্ব মুসলিমের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক ঐক্যের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সিটিজেন টাইমস্/মো. জিল্লুর রহমান/অহ/এমই