English

বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়

বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়
মতামত

বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভারতের মেঘালয়-আসামে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে চলতি মৌসুমের তৃতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে সিলেট অঞ্চলে। একের পর এক বন্যায় বিপর্যস্ত এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। দুই জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। পানি ঢুকে পড়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও। বিদ্যুৎ স্টেশন ডুবে যাওয়ায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পানি প্রবেশ করায় ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক এলাকায় সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বন্যার্ত মানুষ উঁচু স্থান, স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন। অনেকের হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে-এক কথায় নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন বানভাসি মানুষ। বন্যাকবলিতদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য সরকার ইতোমধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে।

পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টির কারণে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, কুশিয়ারা, সুরমা ইত্যাদি অববাহিকার নদ-নদীতে পানি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলাগুলোতেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা কয়েক লক্ষ এবং এসব মানুষ এখন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন তারা। অনেকেই পরিবারসহ ছোট ছোট নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেই অনাহারে-অর্ধাহারে চলছে তাদের বানভাসি জীবন-যাপন। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। অনেক জায়গায় বিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ। সরকারের ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ সহজ করতে ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬-২০২০ সালে নির্মিত হয়েছিল ২৯.৭৩ কিলোমিটারের দীর্ঘ একটি সড়ক, কিন্তু ওই অঞ্চলে সুবিধা দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাস্তাটি। অকাল বন্যায় হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। এবারের অকাল বন্যার পর থেকেই আলোচনায় আসে এই সড়ক। এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করছেন, প্রত্যেক বছরই বর্ষা মৌসুমে ভারতের পাহাড়ি ঢল নামে। আগে ঢল এলেও পানি দ্রুত নেমে যেতো। এখন পানি আটকে থাকে কয়েকদিন। এতে পানিতে ধান পচে যায়। এ বছরও অকাল বন্যায় তলিয়ে যায় হাওরাঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধান। এতে ক্ষতির পরিমান হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় মানুষ, বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে মন্ত্রীসভায় আলোচনা হয়েছে হাওরের জন্যে ভয়ের কারণ হয়ে ওঠা কিশোরগঞ্জের এই সড়ক নিয়ে। হাওরের বন্যায় এই সড়কের কোন প্রভাব রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে বলেছে সরকারের মন্ত্রীসভা। একইসঙ্গে হাওর এলাকায় আর কোন সড়ক নির্মাণ না করারও নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওার আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা না চালানো এর অন্যতম কারণ। পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ, বলছেন, এ সড়ক নির্মাণের আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা চালানো হয়নি। হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো জলের অবাধ প্রবাহ। তাদের মতে, সড়ক যদি নির্মাণ করতেই হয় তাহলে যেন ৩০ কিলোমিটার এই সড়কের অন্তত ৩০ ভাগ জায়গা উঁচু সেতু বা উড়াল সড়ক আকারে বানিয়ে পানি প্রবাহের সুযোগ রাখা হয়। এছাড়া এই সড়কের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো হলো, এটি একা দাঁড়িয়ে থাকা এক সড়ক, এই সড়ক ব্যাপক অর্থে কোনো সংযোগ তৈরি করছে না। সড়কটি নির্মাণের মাত্র দুই বছর হয়েছে। আরও সময় গেলে, বড় বড় বন্যার তোড় দেখা দিলে এই সড়কের পরিবেশগত প্রভাব আরও স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক মানুষকে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে তোলে। তাই যখনই অতিবৃষ্টি, ঝড়, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে অসহায় মানবতার পাশে দাঁড়ানো দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অবশ্য কর্তব্য। বিপদের সময় বানভাসি মানুষের সেবায় এগিয়ে এসে প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। বিপদগ্রস্ত লোকেরা সাহায্যের অর্থ, ত্রাণসামগ্রী, খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ, খাওয়ার স্যালাইন, বিশুদ্ধ পানি বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে খুবই উপকৃত হয়। যারা অসহায়, ক্ষতিগ্রস্ত, অভাবী, গরিব-দুঃখী এবং অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানহীন মৌলিক অধিকার বঞ্চিত মানুষকে ত্রাণ সাহায্য করে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন, তারাই সত্যিকারের মানব দরদী। 

বন্যায় অনেক দরিদ্র পরিবারের বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ ও জীবন-জীবিকার ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বহু রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বসতভিটা, জমি-জিরাত ও ফল-ফসল নিশ্চিহ্ন ও বিলীন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বন্যা কবলিত অঞ্চলের অসহায় বানভাসি মানুষ কতটা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পড়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকায় পানিবাহিত নানা ধরনের রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের অভাবে তারা সুচিকিৎসা পাচ্ছে না। দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় প্রবল স্রোতে পানির সংযোগ পাইপ, গভীর নলকূপ ও কুয়া চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সর্বত্র বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় মানবেতর জীবনযাপনরত বানভাসি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ তৎপরতা, শুকনা খাদ্যসামগ্রী প্রদান, আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। 

দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে অসহায় মানুষ যখন পানিবন্দী অবস্থায় জীবন যাপন করছে, তখন সমাজের বিত্তবানদের বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও সাহায্য সহযোগিতা করা নৈতিক দায়িত্ব। টাকাপয়সা, খাদ্য, বস্ত্র, পানি, ওষুধ—যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসার এখনই সময়। বন্যা উপদ্রুত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসি মানুষ অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসার অভাবে অর্ধাহারে অনাহারে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে দিন যাপন করছে। দুঃখের রজনী যেমন শেষ হতে চায় না, তেমনি বানভাসি মানুষের কাছে এখন একেকটি দিন যেন দুর্বিষহ কষ্টের অনন্তকাল। 

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের নাগরিক সমাজ সিলেট ও সুনামগঞ্জকে ‘জাতীয় দুর্যোগপূর্ণ’ এলাকা ঘোষণা করার দাবী জানিয়েছেন। তাদের বলছেন, "সরকারি উদ্যোগে দ্রুত যথাযথ ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছাতে হবে। সুরমা, কুশিয়ারা, মনু নদীসহ হাওড় এলাকাকে দুর্যোগ মোকাবিলায় উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। নদী তীরবর্তী এলাকারগুলোকে উপযুক্ত বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আশ্রয়ণ প্রকল্প অত্যন্ত স্বল্প। পর্যাপ্ত আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তুলতে হবে। বন্যায় যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, তাদের সরকারিভাবে অনুদান প্রদান করা হোক এবং তাদের ক্ষয়ক্ষতিগুলো পূরণ করা হোক।" আসলে সমাজে যারা বিত্তবান, তারা সবাই চিত্তহীন নন, বর্তমান প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। এ জন্য দেশের ধনাঢ্য ও সংগতিসম্পন্ন লোকেরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র ব্যক্তিদের পরিবার পরিজন ও আত্মীয় স্বজনকে মুক্ত হস্তে সাহায্য করতে পারেন। 

সুতরাং যে প্রান্তেই থাকুন, নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বন্যার্তদের সাহায্য-সহযোগিতা করুন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য অর্থ তহবিল সংগ্রহ, সাহায্য-সহযোগিতা ও বিতরণের সময় স্থানীয় প্রশাসন, উন্নয়নকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তাই সরকারের ত্রাণের দিকে না তাকিয়ে আর্তমানবতার সেবায় সবাই স্বেচ্ছায় যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বন্যার্তদের সহায়তায় এগিয়ে আসুন! ঐক্যবদ্ধভাবে সবাই যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যত বড়ই হোক না কেন, তার মোকাবিলা করা কঠিন হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।



লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট ।



সিটিজেন টাইমস্/মো. জিল্লুর রহমান/অহ/এমই