English

পদ্মা সেতু: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন

পদ্মা সেতু: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন
মতামত
দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হতে যাচ্ছে ২৫ জুন। এ দিনটি বাঙালি জাতির জন্য উৎসব ও প্রেরণার। আমি প্রথমেই ধন্যবাদ জানাতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কারণ, তাঁর দৃঢ় মনোবল, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা ছাড়া এই সেতু নির্মাণ সম্ভব হতো না। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিলো অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু, তিনি তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন।

স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নির্মাণ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের। একই সাথে তা ছিলো নতুন ভাবনার, নতুন এক প্রেরণার উৎস। পদ্মা সেতু এখন আমাদের সক্ষমতার প্রতীক। বাংলাদেশ যে ‘পারে’, পদ্মা সেতু নির্মাণ করে তা কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের বুকে আমরা মাথা উঁচু করে সগৌরবে বলতে পারছি যে, ‘আমরাও পারি’। পদ্মা সেতু যেরকম দক্ষিণাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকার সাথে সংযুক্ত করবে, ঠিক সেভাবে আমাদের মনোবল ও সাহস যোগাচ্ছে। অদম্য মানসিক দৃঢ়তা এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে আমরা মনে করি, আমাদের কোনো কিছুতেই আর দাবায়ে রাখা যাবে না।

একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’। সেইটারই কিন্তু আরেকটা নিদর্শন আমরা দেখতে পাচ্ছি। বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা সবাই মনে করছি যে, আমাদের একটা বিশাল অর্জন হয়েছে, যা ছিলো স্বপ্ন, তা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এটা অসাধারণ অর্জন। বিশ্বব্যাপী এখন পদ্মা সেতু নির্মাণের সাফল্য ও চ্যালেঞ্জের কথা উচ্চারিত হচ্ছে।

অর্থনীতির কথা যদি আমরা বলি, আমরা খুব ভালো করে জানি যে দীর্ঘদিন ধরে এই দক্ষিণাঞ্চল রাজধানী ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। আর শুধু এ কারণেই দক্ষিণাঞ্চলের এ বিশাল ভ‚-খন্ড নানাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। খুলনা-সাতক্ষীরা-যশোর বা পটুয়াখালী-বরিশাল-বরগুনা যাতায়াতে ৮-১০ ঘণ্টা সময় লাগতো। অনেক সময় তার চেয়েও বেশি লাগতো, সেটা এখন মাত্র চার ঘণ্টায় সম্ভব হবে। এর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে এই অঞ্চল থেকে উৎপাদিত কৃষি দ্রব্য অতি সহজেই, অল্প সময়ে তা রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলে পৌছে যাবে। ফলে কৃষক পণ্যের যথাযথ মূল্য পাবে এবং নানাভাবে উপকৃত হবে। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলে একসময় যে শিল্পায়নের গতি ছিলো, সেই গতি কিন্তু সময়ের সাথে হারিয়েছে। আমরা সেই গতিটা আবারও ফিরে পাবো বলে আশা করছি।

আমরা জানি, মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে ব্যাপক শিল্পায়নের যে প্রক্রিয়া চলছে এবং এ বন্দরের উন্নয়নে যে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে, এর ওপর পদ্মা সেতু সরাসরি প্রভাব রাখবে। এছাড়া পদ্মা সেতুর পরোক্ষ ইতিবাচক প্রভাবও পড়বে নানা ক্ষেত্রে। বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে তার মধ্যে  পরিবহন ও যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প, পর্যটন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, তথ্য-প্রযুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্য।

অনেক অর্থনীতিবিদ আছেন, যাদের বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে আমরা জানতে পারি যে, পদ্মা সেতু ১% থেকে ২% পর্যন্ত আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে। আমার কাছে মনে হয় যে, এর চেয়ে আরও অনেক কিছু আছে যেটা আমরা এখনও অনুধাবন করতে পারছি না। কারণ, এই অঞ্চলে যখন শিল্পায়ন হবে, সেই শিল্পায়নের একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে  দেশের উপক‚লীয় এলাকা। যার জন্য আমরা মাতারবাড়িতে উন্নয়নগুলো দেখছি, তারপরে আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দর দেখছি এবং কক্সবাজার, মহেশখালী ও স›দ্বীপ এখানে যে ধরনের উন্নয়ন দেখছি, সুতরাং তাতে বলতে পারি উপক‚লীয় অঞ্চলজুড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। সেই উন্নয়নের রোডম্যাপে আমরাও কিন্তু যুক্ত হয়েছি। পদ্মা সেতু আমাদের মোংলা পোর্ট এবং এই অঞ্চলের শিল্পায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আমি মনে করি যে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা অঞ্চলে অন্যান্য যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে তার সবার জন্য কিন্তু নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। এখন আমরা ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রয়োজনে আমাদের যে দক্ষ জনশক্তি দরকার তা গড়ার ভ‚মিকা তা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই নিতে হবে। এই পদ্মা সেতুকে আমরা সামনে ধরে রেখে আমাদের যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া, যেটা শুরু হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে যেনো আমরা চলতে পারি। সেজন্য আমাদেরও অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী কোয়ালিটি এডুকেশন দিতে হবে, যেগুলো আসলেই শিল্পায়ন এবং বিশ্বায়নের যুগে যেনো যথাযথভাবে কাজ করতে পারে।

আমরা যখন পর্যটন শিল্পের কথা বলি, তখন কক্সবাজারের কথাই উঠে আসে। প্রতিবছর বিভিন্ন সময় সেখানে পর্যটকের ঢল নামে। কিন্তু সেই অর্থে আমাদের সুন্দরবনের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে, যার প্রতি বিশ্ব আকৃষ্ট এবং এটা ন্যাচারাল হেরিটেজ সাইট, সেই অনুযায়ী এখানে পর্যটকরা আসছেন ঠিকই, কিন্তু খুব বেশি নয়, যতটা আমরা আশা করছি। এর অন্যতম কারণও কিন্তু এই যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমরা যতটুকু দেখতে পাই, পদ্মা সেতু চালু হলে সুন্দরবনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে এবং মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত সরাসরি সড়ক পথে পশ্চিম অংশেরও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক হবে। এছাড়া বাগেরহাট থেকে মোড়েলগঞ্জ-শরণখোলা পর্যন্ত সুন্দরবনের যে পূর্ব অংশ সেখানেও কিন্তু সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। এর ফলে পর্যটন শিল্পে একটা অবারিত সম্ভাবনা দেখা দেবে। এই সম্ভাবনা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা।

পদ্মা সেতু চালু হলে পর্যটক অবশ্যই আসবে। পাশাপাশি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং তার যে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্য, তার যে ইকলোজিক্যাল সার্ভিসগুলো রয়েছে, এই অধিক ও অপরিকল্পিত পর্যটকের কারণে সেগুলোর যেনো ক্ষতির কারণ না হয়। সেজন্য পর্যটককে অবশ্যই আমরা আহŸান জানাবো, পাশাপাশি যথাযথ পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমাদের অবকাঠামোগত এবং আইনগত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে বলবো বাংলাদেশ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকার রয়েছে, তারা নিশ্চয়ই তা নিয়ে ভাববে। মাস ট্যুরিজম না করে কনট্রোল ইকোট্যুরিজমের দিকে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। ফলে আমাদের সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল যে জনগোষ্ঠী রয়েছে তারাও উপকৃত হবে। এই ইকোট্যুরিজমে তারাও নানাভাবে সম্পৃক্ত হতে পারবে।

আসলে যখন পর্যটক কোনো একটি জায়গায় আসে, তখন সে চিন্তা করে যে একটি এলাকায় যেয়ে আমি কতগুলো নিদর্শন দেখতে পারবো। সেই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে শুধু সুন্দরবন নয়, সুন্দরবনের আশেপাশে আরও অনেক পর্যটন স্থান  রয়েছে। বাগেরহাটে ষাটগম্বুজ মসজিদ রয়েছে, পীর খানজাহান আলী (রহ.) এর মাজার রয়েছে, এদিকে দক্ষিণডিহি রয়েছে। আরেকটা জিনিস উল্লেখ করার মতো, তা হচ্ছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, যা আগামী দু-এক মাসের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ এর আওতায় চলে আসবে। বেকুটিয়াসহ যে সেতুগুলো নির্মাণাধীন ছিলো, সেগুলো এরই মধ্যে উদ্বোধনের অপেক্ষা রয়েছে। সুতরাং এই পুরো অঞ্চল ধরে তথা সুন্দরবন, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর এবং কুয়াকাটা মিলে একটা পর্যটন অঞ্চলে পরিণত হবে। আশা করা যায়, অর্থনৈতিকভাবে পদ্মা সেতু এই অঞ্চল, এই পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যাবে। সাধারণ মানুষেরও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। এছাড়া আমাদের স্বাস্থ্যখাতে কিন্তু একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, উন্নত চিকিৎসাসেবা পেতে সহজে মানুষ ঢাকায় যেতে পারবে। আবার ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা খুলনায় এসে চিকিৎসাসেবা দিতে পারবেন।

পদ্মা সেতুর কারণে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হবে। সার কথায় বলতে গেলে, পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য নানামুখী সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। যা দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। পরিশেষে আমরা বলতে পারি বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় আমাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ, স্বাধীন ভ‚-খন্ড এনে দিয়েছেন। আর তাঁরই রক্তের উত্তোরাধিকারী, তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণে সদর্পে এগিয়ে যাচ্ছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ সেই স্বপ্নেরই মাইলফলক।  পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অন্যরকম এক বিজয় ও প্রেরণার পতাকা উজ্জীবিত করলো। পদ্মা সেতু নির্মাণের এই সাফল্য গাঁথা অনাগত কাল ধরে বাঙালি জাতির প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।



লেখক: উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।


সিটিজেন টাইমস্/সিআর/এমই