মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে একজন কেন্দ্র সচিব ও প্রধান শিক্ষকসহ তিন শিক্ষককে গ্রেপ্তারের খবর গণমাধ্যমে খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। উপরোক্ত প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে প্রশাসনের কর্মকর্তারা পরবর্তী পরীক্ষার কিছু প্রশ্নপত্র উদ্ধার করেছেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাকেসহ অভিযুক্ত অপর দুই শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক, লজ্জার এবং বিব্রতকরও বটে। একজন শিক্ষক জাতির কান্ডারী ও মানুষ গড়ার কারিগর কিন্তু তার পরও সে তার উপর অর্পিত গুরুদায়িত্ব ভঙ্গ করে চরম বিশ্বাস ঘাতকতার কাজ করেছেন। মহান শিক্ষকতা পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এ কারণে পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানোর ক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব দৃশ্যত নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, "কেন্দ্র সচিবরাই যদি এটা করেন। কাউকে না কাউকে দিয়ে তো কাজটা (প্রশ্ন বিতরণ) করাতে হবে। সে যদি কাজটা এরকম করে ফেলে, ভবিষ্যতে আমরা কী করতে পারি?" বিগত বছরগুলোতে প্রশ্ন ফাঁসের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সরকারও বিষয়টি নিয়ে বেশ বিব্রত ও চিন্তিত। উপরোক্ত ঘটনাটি বেশ বুমেরাং এবং স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তাড়াবে কে কিংবা বেড়ায় ক্ষেত খাওয়া শুরু করলে ক্ষেত রক্ষা করবে কে!
আমরা জানি, শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদন্ড। আর সে মেরুদন্ড গড়ার কারিগর হলেন গোটা শিক্ষক সমাজ। সুশিক্ষা, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলবেন, এটিই শিক্ষকদের কাছে সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু আজ শিক্ষক সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু অংশের চরিত্রেই যেন ঘুণে ধরেছে। একজন আদর্শবান শিক্ষক একটি সমাজকে আলোকিত করতে পারেন আবার একজন নীতি নৈতিকতাহীন চরিত্রহীন শিক্ষক একটি সমাজকে ধ্বংসও করে দিতে পারেন। আগেকার দিনে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হতো শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয়, কারণ-প্রতিকার শিরোনামে। অথচ আজ শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন নিয়ে লিখতে হচ্ছে বলে চরম লজ্জাবোধ করছি। এজন্য সকল আদর্শবান শিক্ষকদের কাছে প্রথমেই করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, তাদের উদ্দেশ্যে এ লেখা নয়; যারা সমাজ ও জাতিকে কলঙ্কিত ও দূষিত করছে এ লেখা তাদের জন্য।
শিক্ষকরা সমাজের আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তি। কিন্তু সেই আদর্শনীয় কোন ব্যক্তি নীতি আর নৈতিকতার মুখোশে মুখ ঢেকে রেখে দিনের বেলার চরিত্র একরকম ও রাতের চরিত্র ভিন্নরকম করে থাকেন এবং তা যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সমাজ তথা পুরো দেশের কাছে কতটা ঘৃণিত হন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়, কিংবা যখন নিজ কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর সাথে আপত্তিকর ফোনালাপ কিংবা ভিডিও সকলের কাছে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেই শিক্ষকের কর্মকান্ড কেবলমাত্র সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই কলঙ্কিত করেনা, বরং তা পুরো শিক্ষক সমাজকে কলুষিত করে।
ছোট বেলায় শিক্ষকরা বারবার শিখিয়েছেন, পরীক্ষার খাতায় বহুবার লিখেছি এই বিখ্যাত প্রবাদটি- 'If money is lost, nothing is lost. Health is lost, something is lost. But character is lost, everything is lost.' কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের চরিত্র নিয়েই শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করতে হয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি আজ যেন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রীকে বেশি নাম্বার পাইয়ে দেবার প্রলোভন দেখিয়ে অনৈতিক প্রশ্ন ফাঁসের কার্য সম্পাদন করা কতিপয় শিক্ষকের যেন এখন নিত্যদিনের কাজে পরিণত হয়েছে। প্রায়ই পত্রিকায় শিক্ষক-ছাত্রীর কু-কর্মের কথা প্রকাশিত হয়। এতে একদিকে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলে মেয়েকে পড়তে পাঠিয়ে তাদের অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন এই ভেবে যে তার সন্তান সম্ভ্রম নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারবে কি না অপরদিকে এখন যেসব মেয়েরা কলেজ কিংবা স্কুল পর্যায়ে পড়ছে, তাদের অভিভাবকেরা সন্তানকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। ফলে দেশের নারী শিক্ষার হার যেভাবে অগ্রগতি ছিল, তাতে ভাটা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অভিযোগ আছে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবতা, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন আলোকিত মানুষ গড়ে উঠছে না। শিক্ষার্থীরা ভালো রেজাল্টের জন্য এ কোচিং সেন্টার থেকে সে কোচিং সেন্টারে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলছে। অভিভাবকরাও চান একটা ভালো রেজাল্টের সার্টিফিকেট। সততা ও নীতি-নৈতিকতা এখানে মূল্যহীন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র চড়া দামে হলেও কিনে নিয়ে সন্তানের হাতে তুলে দিতে ছুটছেন। সর্বত্র চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। মানহীন, সার্টিফিকেট সর্বস্ব লেখাপড়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জীবনের শুরুতেই শিক্ষার্থীরা নীতি-নৈতিকতাহীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আমরা জেনে এসেছি, বাবা-মায়ের পরেই শিক্ষকের স্থান। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। জ্ঞানের পাদপ্রদীপ। কিন্তু কতিপয় দুর্নীতিবাজ শিক্ষকের জন্য এবং মানহীন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য পুরো শিক্ষক সমাজ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার চেয়ে ব্যস্ত থাকছেন নীতি-নৈতিকতাবর্জিত অর্থহীন কাজের সঙ্গে। শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরিতে বসে জ্ঞানচর্চা করার কথা, কিন্তু লাইব্রেরি এখন জনশূণ্য। এখানে জ্ঞানচর্চা করতে আগ্রহীর সংখ্যা কমে আসছে। মেধাশূন্য জাতি দিয়ে পরিবার, সমাজ তথা জাতি চলবে কী করে? মেধাবীরা উন্নত, সচ্ছল জীবনের আশায় দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া বিত্তবানরা তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বিত্তবান অভিভাবকদের অবৈধ অর্থ সন্তানদের বেপরোয়া করে তুলছে।
একটি দেশের টেকসই উন্নয়ন তখনই নিশ্চিত হয়, যখন সে দেশে সঠিক মাত্রায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা হয়। নীতির প্রতি মূল্যায়ন, সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকেই আসে নীতিবোধ আর এই নীতিবোধ থেকেই নৈতিকতা। অন্যদিকে নিজের বুদ্ধি ও সক্ষমতার দ্বারা প্রতিটি জিনিস ও কাজের ভাল-মন্দ, দোষ-গুণ বিচার-বিশ্লেষণ বা মূল্যায়ন করার মানসিকতাই হলো মূল্যবোধ। সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নৈতিক মূল্যবোধ হলো এমন কিছু নির্দেশিকা, যা একজন ব্যক্তিকে সঠিক এবং ভুলের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। দৈনন্দিন জীবনে সৎ, বিশ্বাসযোগ্য এবং সঠিক সম্পর্ক তৈরি করতে, মানুষের নৈতিকতার সচেতনতা- সঙ্গে আত্ম-সচেতনতা-অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিক মূল্যবোধ একজন ব্যক্তিকে তার আচরণকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। সুতরাং, নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জাতিকে নৈতিক মূল্যবোধের সংকট থেকে মুক্ত করতে শিক্ষার বিকল্প নেই।
আমরা জানি যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। যুগের পর যুগ জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের ধারকগণের মন, মগজ, মস্তিষ্কের পরিস্ফুটন ঘটানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান হচ্ছে শিক্ষকদের। শিক্ষকরা হচ্ছে প্রধান চালিকা শক্তি, জাতির বিবেক ও মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের হাত ধরেই উদিত হয় জাতির সোনালী দিন। কিন্তু সেই শিক্ষকদের একটি অংশ যদি অসৎ হয় কিংবা অর্থের লোভে নীতি নৈতিকতাহীন কাজ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত হন, তা জাতির জন্য সত্যিই বেদনাদায়ক ও চরম লজ্জার। এ লজ্জা ও অসম্মান সকলের।
শিক্ষকতা সমাজের সর্বোপরি মর্যাদাপূর্ণ পেশা। সে মর্যাদায় যেন এখন যেন পচন ধরেছে এবং তা শুধু কেবলমাত্র কতিপয় অসৎ ও নীতি নৈতিকতাহীন শিক্ষকের জন্য। আমাদের সমাজে এখনও অনেক সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক রয়েছেন। কতিপয় শিক্ষকের অসৎ কর্মে তারা প্রতিনিয়ত অপমানবোধ করছেন। এখনই সময় রুখে দাঁড়ানোর। যারা শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে কলুষিত করছে তাদের সাময়িক নয়, আজীবন বহিষ্কার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এইজন্য সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন। রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে যেন কোনও অপরাধী পার পেয়ে যেতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর রাষ্ট্রকে রাখতে হবে। এছাড়া এ ধরনের অপরাধীদের ক্ষেত্রে শূণ্য সহনশীল নীতি বা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা দরকার। এছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের পাঠদানের পদ্ধতি, ব্যক্তিত্ব, নৈতিকতাসহ বিভিন্ন বিষয় ভিত্তি করে জরিপ চালানো যেতে পারে। এতে বেরিয়ে আসবে আরও নিত্য নতুন তথ্য।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দেশের জন্য শিক্ষকদের রয়েছে প্রশংসনীয় ভূমিকা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বই-এর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা ছিল অনবদ্য ও অতীব প্রশংসনীয়। তাদের নেতৃত্ব, দিক-নির্দেশনা থেকে তখন ধাপে ধাপে জাতির বিভিন্ন শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তি লাভ করেছিল। তাদের এই সম্মানকে কখনও ধূলিসাৎ করতে দেয়া যাবে না। একজন ছাত্রকে শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করে আদর্শ চরিত্রবান মানুষরূপে গড়ে দেশ সেবায় নিয়োজিত করতে একজন সম্মানিত শিক্ষকের ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও সেই কারিগরদের নৈতিকতায় যদি কালিমা লেগে যায়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কান্ডারিদের কি হবে সেটি প্রশ্ন থেকেই যায়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তাড়াবে কে কিংবা বেড়ায় ক্ষেত খাওয়া শুরু করলে ক্ষেত রক্ষা করবে কে!
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট ।