English

করপোরেট সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি

করপোরেট সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
মতামত

ড. প্রণব কুমার পান্ডে

কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠেছে। প্রত্যেক বছরই রোজার ঈদের সময় বাজারে কয়েকটি পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যায়। বেশ বহুদিন যাবৎ রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে কয়েকটি পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে দাম বৃদ্ধি করে। সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন বিভাগ বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এবং সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে আবার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বিশেষত রোজার ঈদ শেষ হলেই সেসব পণ্যের মূল্য আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এটি বাংলাদেশের জনগণ অনেক বছর ধরেই দেখে আসছে।

একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ঈদে মানুষকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রয়াসে এই কাজটি করে। তবে পাশাপাশি এটাও ঠিক, তাদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ বিভিন্ন বিভাগ বেশ তৎপর থাকে এই সময় এবং তারা প্রায়ই সফল হয় সিন্ডিকেট ভাঙতে।

তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। রোজা শুরু হওয়ার আগেই রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী দেখা যায়। বাংলাদেশ তেলসহ যেসব পণ্য আমদানি করে সেসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে দেশের বাজারে তেলসহ অন্যান্য কয়েকটি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে রোজা শুরু হওয়ার আগে থেকে। তবে এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধি শুধু রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য হয়েছে এই বিষয়টি ঠিক নয়। কারণ, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের বাজার পর্যবেক্ষণ থেকে যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে সেটি হচ্ছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রচুর পরিমাণে তেল অবৈধভাবে মজুত করে অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করেছিল।

ঈদের দুদিন আগে এবং দুদিন পরে ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব অঞ্চলে খুচরা বাজারে সয়াবিন তেল সরবরাহ একেবারেই শূন্যের কোঠায় ছিল। ঈদের কয়েকদিন পরে সরকার যখন সয়াবিন তেলের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করে প্রতি লিটার ১৬০ টাকা থেকে ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করে, তার ঠিক একদিন পর থেকেই বাজারে তেলের সরবরাহ বেড়ে যায়।

ফলে স্বভাবতই মানুষের মধ্যে যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল তা হলো কী এমন ঘটনা ঘটলো যে তিন-চার দিনের মধ্যেই বাজারে তেলের সরবরাহ বেড়ে গেলো। এখানে বলে রাখা ভালো যে সেই কয়দিনের মধ্যে দেশের বাইরে থেকে কোনও তেল আমদানি সম্ভব হয়নি। কারণ, ঈদের ছুটিতে সকল বন্দর বন্ধ ছিল। ঈদ পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে তেলের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করার সময় হতাশা নিয়ে বলেছিলেন, তিনি ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে ভুল করেছেন। সেই বৈঠকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল ঠিক কী কারণে বাজারে তেলের সরবরাহ কমে গেলো? এই প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ী নেতারা কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। অর্থাৎ এটা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে একশ্রেণির করপোরেট ব্যবসায়ী বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে অধিক পরিমাণ মুনাফা লাভের আশায় তেল মজুত করে রেখেছিল।

দেশব্যাপী মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মজুতদারদের চিহ্নিত করাসহ সরকারের কয়েকটি শক্ত পদক্ষেপের ফলে বাজারে তেলের মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। তেলের মূল্য স্থিতিশীল হতেই বাজারে চালের এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। এই করপোরেট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে গত দুই মাসের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার চালের মূল্য প্রতি কেজিতে অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। দামের দিক থেকে এমনও হয়েছে যে প্রতি কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে চালের।

গত কয়েকদিন যাবৎ বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে যে বিষয়টি প্রচারিত হয়েছে তা হলো, বাংলাদেশের বড় বড় করপোরেট হাউজগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে চালের মিল ভাড়া নিয়ে প্যাকেটজাত চাল বাজারে সরবরাহ করছে। তাদের এই প্যাকেটজাত চালের মূল্য বাজারের অন্যান্য চালের মূল্য থেকে অনেক বেশি। এসব করপোরেট ব্যবসায়ীরা দেশব্যাপী মিল ভাড়া নিয়ে চাল কিনে মজুত করার ফলে একদিকে যেমন ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ঠিক তেমনি কৃষকরাও চালের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে অনেক বেশি দাম দিয়ে মানুষকে চাল কিনতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ভাড়া করা চালের মিল চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ মজুত করা চাল জব্দ করা হয়েছে।

এই বিষয়টি সম্পর্কে কথা বলবার সময় খাদ্যমন্ত্রী খুব শক্তভাবে বলেছেন, এসব করপোরেট হাউজ মিল ভাড়া করে চালের ব্যবসা করতে পারবে না। তাদের চালের ব্যবসা করতে হলে নিজেদের মিলের মালিকানা নিয়ে তারপরে চালের ব্যবসা করতে হবে। এছাড়া তাদের ৬৭% কর প্রদানের মাধ্যমে চাল আমদানি করে বাজারজাত করতে হবে। ফলেএই বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালের ব্যবসায় থেকে বিরত করা না গেলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। এটা ঠিক যে বাংলাদেশে প্রত্যেকেরই অধিকার আছে সরকারের নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করার। কিন্তু করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এই রকমভাবে স্থানীয় পর্যায়ে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যে মজুত করে ব্যবসা করে তাহলে একদিকে যেমন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে, ঠিক তেমনি ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসা করতেই হয় তাহলে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসায়ীরা যেভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে সেভাবেই তাদের ব্যবসা করতে হবে। খাদ্যমন্ত্রী ইতোমধ্যে স্পষ্টভাবে বলেছেন প্যাকেটজাত চাল সরবরাহ বাজারে নিষিদ্ধ করা হবে। তবে এই কথাগুলো মুখে বললেই হবে না, খুব শক্তভাবে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে।

আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ করেছি বাজারে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়ে গেছে। বর্তমান সরকারের একটি বড় সফলতা ছিল ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজতর করা। এমনকি ২০১৫ সালে সরকারি বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ করার পরেও বাজারে এর প্রভাব তেমনটা পড়েনি। ফলে জনগণ বেশ সুখেই ছিল। এর মূল কারণ ছিল বেশিরভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাজারের অস্থিরতা সাধারণ মানুষের জীবনে ভোগান্তির নিয়ে এসেছে। মানুষের এই অস্বস্তিকে কাজে লাগানোর জন্য একটি শ্রেণি সবসময় তৎপর রয়েছে।

তবে এটিও ঠিক, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের তরফ থেকে সকল ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরলস প্রচেষ্টায় দেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। দেশের অর্থনীতি একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে গত দুই বছর চলমান করোনা অতিমারির সময়ও মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।  করোনা অতিমারির কারণে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা থাকলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব তেমনটি পড়েনি। ফলে শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও অনেকটা শক্তিশালী অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

যেকোনও দুর্যোগ মোকাবিলা করার দায়িত্ব সরকারের একার নয়। সরকারের পাশাপাশি জনগণ, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজসহ সকলের উচিত এক হয়ে কাজ করে দুর্যোগ মোকাবিলা করা। কিন্তু বাংলাদেশে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এক ধরনের সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনে ব্যস্ত রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে বাজারে স্বস্তি ফেরালে জনগণ আশ্বস্ত হবে। তবে এটাও ঠিক, আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাংলাদেশের বাজারেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হচ্ছে। অতএব, একশ্রেণির মানুষ যারা সরকারের সকল কাজের সমালোচনায় ব্যস্ত রয়েছেন, তাদের উচিত প্রথমে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করা এবং পরে এ বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করা। সমালোচনার জন্য সমালোচনা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। কারণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর বাংলাদেশের জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। আমরা আশা করি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এ অবস্থার পরিবর্তন হবে।


লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।