রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার
বাসিন্দাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় এক ব্যাগভর্তি পলিথিনে গৃহস্থালির
অবর্জনা পড়ে আছে। সেটা থেকে দুর্গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে; মানুষজন খুব
কষ্টে নাক মুখ চেপে তার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। এ যেন আমাদের স্বাভাবিক
দিনগুলোতে ঘটে যাওয়া নিত্য এক সাধারণ গল্পকথা।
এছাড়াও অনেকে ময়লা
নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে না ফেলে পয়ঃনিষ্কাশন নালায় ময়লা ফেলেন। যার ফলশ্রুতিতে
নালায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। আর্বজনা ফেলার ডাস্টবিন এর চারপাশে ও এতো
পরিমাণ আর্বজনা থাকে যে, কোনো রুচিসম্মত মানুষ সেখানে গিয়ে ময়লা ফেলার
পরিবেশ পায় না কিংবা কিছু জায়গায় যথাযথ পরিবেশ পেলেও ডাস্টবিন থেকে পূর্ব
দিনের জমানো ময়লা যথা সময়ে সরিয়ে নেয়া হয় নি। এসব যেন আমাদের সাথে নিত্য
দিনের একটি পরিচিত গল্প। এই জিনিস গুলোর জন্য যে যথাযথ ব্যাপস্থাপনা রয়েছে
সেটা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছি। এমনটা প্রায় সময়েই হয় যেন রাস্তায় চিপস খেয়ে
ডাস্টবিনের কাছে গেলাম চিপসের প্যাকেট ফেলতে আর গিয়ে দেখি ডাস্টবিন আগে
থেকেই পূর্ণ হয়ে আছে। তারপর সেই চিপসের প্যাকেট টা এখন কোথায় ফেলবো? বাধ্য
হয়েই অনেকে তখন রাস্তায় ফেলেন। এসকল ঘটনাগুলো থেকে খুব অপ্রীতিকর ও
বিরক্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে আমাদের চারপাশে। এখন তবে আসা যাক এই
বিরক্তিকর সমস্যার পেছনের মূল কারণ টা কোথায় সেটার দিকে। প্রতিদিন ৫ হাজার
মেট্রিক টনের ওপর ময়লা তৈরি হয় রাজধানী ঢাকায়। প্রতিদিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির
সাথে সাথে ময়লা আর্বজনা তৈরীর পরিমাণ ও বেড়েই চলছে। ময়লা ফেলার নির্ধারিত
জায়গা ও পর্যাপ্ত আস্তাকুঁড়ের (ডাস্টবিন) এর যথাযথ ব্যাবহার ও ব্যাবস্থাপনা
না থাকার জন্য যত্রতত্র আবর্জনার স্তুপ জমে ছোটোখাটো একটা আবর্জনার টিলা
তৈরি হয়ে যায়। নিয়মিত এবং যথাযথ ব্যাবস্থাপনা না থাকায় এসব স্তুপ থেকে যেমন
একদিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পথচারীদের অসুবিধার কারণ সৃষ্টি করছে তেমনি তৈরী
হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের কারণ। এসব ময়লার স্তুপ থেকে তৈরী হওয়া
মিথেন গ্যাস ও লিচেট(ময়লা থেকে নিষ্কাশিত তরল) সহজেই পরিবেশ দূষণের
পাশাপাশি রোগজীবাণু বহনকারী বিভিন্ন কীটপতঙ্গ কে আকর্ষণ করে যা মানুষের
স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। এছাড়াও বর্জ্যের দূষণ থেকে পেটের পীড়া,
চর্মরোগ, ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসকষ্ট, আলসার, গ্যাস্ট্রিক
এমনকি লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়ার মতো কঠিন অসুস্থতার শিকার হয় মানুষ।
আমাদের
মোট আবর্জনার ৩৭% তৈরি হয় রাজধানী ঢাকায়। আবর্জনার যথাযথ ব্যাবস্থাপনা না
থাকায় এ আবর্জনা আমাদের নগর জীবনের এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। এ
সমস্যা উত্তরণে যথাযথ কতৃপক্ষের পরিকল্পিত আবর্জ্যনা ব্যাবস্থাপনা একান্ত
প্রয়োজন। আবর্জনা ব্যাবস্থাপনা বলতে আমরা মূলত আবর্জনা সংগ্রহ, পরিবহন,
প্রক্রিয়াজাতকরণ, পূণর্ব্যবহার এবং নিষ্কাশনের সমন্বিত প্রক্রিয়াকে
বোঝায়। এই শব্দটি দিয়ে সাধারণত মানুষের কার্যকলাপে সৃষ্টি হওয়া
অপ্রয়োজনীয় বস্তুসমূহকে বুঝানো হয়ে থাকে; ঐ বস্তুগুলোর থেকে
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ক্ষতিকারক প্রভাব প্রশমিত করার জন্য, কিংবা পরিবেশের
সৌন্দর্য্য রক্ষার জন্য এদেরকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ উপযোগী করে
তোলা হয়।আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বর্জ্য ব্যাবস্থাপনার জন্য
সাধারণত ল্যান্ডফিলিং পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে।কিন্তু বর্তমান সময়ের সাথে
পাল্লা দিয়ে তৈরী হওয়া অধিক পরিমাণ বর্জ্য পরিকল্পিত ব্যাবস্থাপনার
মাধ্যমে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে তৈরী কোনো ল্যান্ডফিলে নিরসন করা হচ্ছে
না। অপরিকল্পিত ল্যান্ডফিলগুলো থেকে সংগৃহীত কঠিন বর্জ্যের মাত্র ৫৫%
সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে এবং এদের থেকে ও মাত্র ২৫/৩০ ভাগ পুনরায়
ব্যাবহারযোগ্য বিভিন্ন উপাদানে রূপান্তর করা যাচ্ছে। ঢাকার পুরাতন
ল্যান্ডফিলগুলি বর্তমানে বর্জ্যে পরিপূর্ণ হয়ে আছে এবং সিটি কর্পোরেশনগুলি
আধুনিক টেকসই ল্যান্ডফিল ব্যবহারের পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করার পরিবর্তে কেবল
আরও বেশি জমি অধিগ্রহণ করছে।বর্জ্য ব্যাবস্থাপনা নিয়ে কারোর সমাধান মূলক
যথাযথ দৃষ্টি না থাকায় নগর জীবনে এ সমস্যা এক বিষন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে
ইতোমধ্যে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমেই ময়লা সংগ্রহের সুবিধার্থে
ময়লাকে যেভাবে শ্রেণীবিভাগ করা যেতে পারে: (১)পৌর এলাকার
আবর্জনা,(২)বাণিজ্যিক এলাকার আবর্জনা,(৩)শিল্প এলাকার আবর্জনা।এছাড়াও
যেখানে শেষ গন্তব্যস্থল হিসেবে ময়লাকে মূলত মাটিচাপা দেয়া হয় সেখানে
শ্রেণীবিভাগটা হতে পারে: (১)পচনশীল এবং (২)অপচনশীল। যে শহরগুলো তে ময়লা
পুড়ানো হয় সেখানে শ্রেণীবিভাগটা এমন হয়ঃ
দহনযোগ্য,অদহনীয়,পূণর্ব্যবহারযোগ্য,প্লাস্টিক,পুরাতন কাপড়,খবরের
কাগজ,পেট-বোতল,কাচের বোতল,ধাতব বস্তু,অতিরিক্ত বড় ময়লা,ইলেক্ট্রনিক
দ্রব্যাদি ইত্যাদি।আবর্জনা ব্যবস্থাপনার জন্য আবর্জনার গাঠনিক ও রাসায়নিক
বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার থাকাটা খুব দরকার।
আবর্জনার গঠন
সম্পর্কে জানার জন্য নিম্নলিখিত বৈশিষ্টগুলো জানতে হয়: আংশিক অণুপাত
বিশ্লেষণ। বর্জ্য-কণার আকার বিশ্লেষণ। বর্জ্যের জলীয় অংশ। বর্জ্যের ঘনত্ব।
আংশিক অনুপাত বিশ্লেষণে যে সকল আলাদা রকমের উপাদান একত্রে মিশে আবর্জনা
তৈরি হয়েছে সেগুলো চিহ্নিতকরণ এবং এগুলোর (শতকরা) অণুপাত নির্ণয় করা হয়। এ
অংশের অধীনে বর্জ্যের শতকরা ওজনের তালিকা (তথ্যসূত্র: আহমেদ এবং রহমান,
২০০০, Water Supply and Sanitation, ITN-Bangladesh) থেকে জানা যায় যে,
বাংলাদেশে খাবার ও তরকারি বর্জ্য প্রায় ৭০% যেখানে কাগজ ও কাগজজাত সামগ্রী,
প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ, কাচ ও সিরামিক বর্জ্যের পরিমাণ দাড়ায় যথাক্রমে
৪%,৫% ও ০.২৫%। তাই আমাদের গৃহস্থালি বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা আমাদের
অর্বজনার মোট পরিমাণ কমাতে পারে যা আমাদের সুন্দর, আবর্জনার দুর্গন্ধমুক্ত
পরিবেশ উপহার দিতে পারে।
এই গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যাবস্থাপনার পদ্ধতি
আমরা সকলে নিজ ঘর থেকেই শুরু করতে পারি জার্মান পদ্ধতি অনুসরণ করে। এই
গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যাবস্থাপনার পদ্ধতি আমরা সকলে নিজ ঘর থেকেই শুরু করতে
পারি জার্মান পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ পদ্ধতি অনুসারে-রান্নাবান্নার সময় তৈরি
হওয়া যত আবর্জনা তা এক ব্যাগে রাখা, আর কাগজপত্র অন্য ব্যাগে রাখা৷ এরপর
রং অনুযায়ী, ময়লা ফেলার নির্দিষ্টএরপর রং অনুযায়ী, ময়লা ফেলার
নির্দিষ্ট কন্টেইনারে সেগুলো ফেলতে হবে। রঙের বিষয়টিও জটিল নয়, কালো রঙের
কন্টেইনারে ফলতে হবে রান্নাবান্নার সময় উৎপাদিত জৈব আবর্জনা, কাগজপত্রের
জন্য নীল কন্টেইনার আর প্লাস্টিক দ্রব্যের জন্য হলুদ কন্টেইনার৷ এই তিন
ধরনের কন্টেইনার প্রায় সববাড়ির সামনেই কতৃপক্ষ থেকে ব্যাবস্থা করা গেলে
আর আমাদেরকে এদের ব্যবহার সম্পর্কে আইন করে যথাযথ নির্দেশ দেয়া হলে এবং
আইন আমান্যে যথাযথ শাস্তির বিধান করা গেলে বর্জ্য ব্যাবস্থা অনেক সহজেই
সমাধান যোগ্য হবে আশা রাখা যায়। এছাড়াও রয়েছে কাঁচের বোতল ফেলার নির্দিষ্ট
কিছু কন্টেইনার৷ বাদামি, সবুজ আর সাদা বা স্বচ্ছ বোতলগুলো রং দেখে ফেলতে
হয় সেসব কন্টেইনারে৷ তবে ব্যাটারি, অ্যাসিড বা রঙের মতো দ্রব্য ফেলা যায়
না এ সব কন্টেইনারে৷ সেগুলোর জন্য আলাদা পাত্র৷এখানেই শেষ নয়,বাসার
আসবাবপত্র পুরনো হয়ে গিয়েছে এবং সেগুলো ফেলে দিতে হবে; এসব জিনিস ফেলে
দেয়ার জন্য ঠিক করা হবে নির্দিষ্ট কিছু দিন, যে দিনগুলোতে নগর কতৃপক্ষ বা
যাদের সেসব জিনিস প্রয়োজন তারা তা নিয়ে যাবে।এখানে পুরানো জামা কাপড় ফেলার
জন্য ও যথাযথ ব্যাবস্থা রয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে বা পার্কিং
লটে এক ধরনের কন্টেইনার থাকবে যেগুলোতে পুরনো জামাকাপড়, জুতো ফেলা যায়৷
সেগুলো আবার দান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে এবং ব্যবহার উপযোগী পোশাক
গরিব-দুঃখীদের দান করা হবে।এভাবে পরিকল্পিতভাবে ময়লা আর্বজনা ফেলার
উদ্দেশ্য হচ্ছে নিখুঁত ব্যাবস্থাপনার মাধ্যমে আবর্জনা মুক্ত সুন্দর পরিবেশ
তৈরী এবং সংগৃহীত আর্বজনা থেকে সর্বোচ্চ রিসাইক্লিং করা। এক্ষেত্রে পরিবেশ
সুন্দর হাওয়ার পাশাপাশি আমাদের সমাজের অস্বচ্ছল মানুষের ও সাহায্য করা
হবে।আর আমরা পাবো পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যাবস্থার সুন্দর আবাসিক ঢাকা নগরী।
এজন্য
অবশ্যই কতৃপক্ষের দৃঢ় আইনী পদক্ষেপ গ্রহন একান্ত প্রয়োজন, সেই সাথে সাধারণ
মানুষের এ বিষয়ে সচেতন হয়ে কতৃপক্ষের সাথে সম্মিলিত কাজই পারে আমাদের
স্বাস্থ্যকর ঢাকার পরিবেশ উপহার দিতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।