শেখ কামরুল হাসান
আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস যেটা ১মে দিবস নামে সুপরিচিত সারাবিশ্ব দরবারে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১ মে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে বিবেচনা করে যথাযথ মর্যাদার সাথে সরকারিভাবে পালন করা হয়। আজ থেকে ১৩৭ বছর পূর্বে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধমে শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায় করে নিয়েছিলো। সেই সময়ে আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেমন কানাডা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড জার্মানির শিল্প মালিক দ্বারা শ্রমিকদের শোষনের মাত্রা দিন কে দিন বেড়েই চলছিল। শ্রমিকদের অস্বাস্থকর পরিবেশে সপ্তাহে ৬দিনের প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা অমানবিক কাজ করতে হতো এবং তার বিনিময়ে শ্রমিকদের মিলতো সামান্য পরিমান মজুরি। সিংহভাগ লভ্যাংশই ভোগকরতো শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরাই।
১৮৬০ সালে প্রথম দাবি জানানো হয় যে শ্রমিকদের মজুরি না কেটে ৮ঘন্টা শ্রম নির্ধারণের কথা কিন্তু তদানীন্তন সময়ে কোনো শ্রমিক সংঘ না থাকাতে শ্রমিকদের এই দাবি ধোঁপে টেকেনি। আসলে সেই সময়ে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে এই শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলার মতো কোনো শ্রমিক নেতা বা শ্রমিক সংঘ ছিলোনা। এই সময়ে আমেরিকা সহ সকল শ্রমজীবী মানুষের কাছে সমাজতন্ত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং তারা বুঝতে পারে যে মালিকপক্ষের এই শোষণ নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নাই। আর এই জন্যই ১৮৮০থেকে ১৮৮১সালের দিকে শ্রমিকরা গড়ে তোলে Federation of Organized Trades and Labor Unions of United States and Canada । পরবর্তীতে ১৮৮৬ সালে এই ফেডারেশনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় American Federation of Labor। মূলত এই ফেডারেশনের মাধমেই শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।
এই সময়ে আমেরিকার শিকাগো ভিত্তিক অ্যালার্ম নামক একটি পত্রিকাতে শ্রমিকদের শ্রম দাস হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। পত্রিকার এই লেখনিটি যেন শ্রমিক আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে। শ্রমিকরা আরো প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এবং শ্রমিক সংঘঠনদের সাথে বিভিন্ন সমাজপন্থী দলও আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে। ১৮৮৪ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে বেশকিছু শ্রমিক ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ঘন্টা বিশ্রাম এবং ৮ঘন্টা বিনোদোনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে এবং এই তাদের এই দাবি মেনে নেয়ার জন্য সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬সালের ১লা মে পর্যন্ত। এরমধ্যে শ্রমিক প্রতিনিধিরা বারবার মালিক পক্ষের কাছে শ্রমিকদের দাবি নিয়ে ধরনা দিলেও কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। শ্রমিকরা ফুঁসেওঠে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের জন্য। এরপর ঘটে গেলো ইতিহাসের এক বৈপ্লবিক অধ্যায়ের। শ্রমিকদের বেঁধে দেয়া সময় অর্থাৎ ১৮৮৬ সালের ১লা মে তারিখে আমেরিকের শিকাগো শহরের রাস্তায় আন্দোলনের জন্য নেমে আসে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ শ্রমিক। তারা সবাই হে-মার্কেট স্কয়ার নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবি আদায়ের জন্য স্লোগান তুলতে থাকে। ফলে শিকাগো শহরের হে-মার্কেট স্কয়ার হয়ে ওঠে শ্রমিক প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মূল মঞ্চ। আন্দোলন চলতে থাকে।
এই সময় অগাস্ট স্পীজ নামের এক শ্রমিক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্যেশে বলিষ্ট ভাষণ দেন। দূরে দাঁড়িয়ে পুলিশ সদস্যরা নজরদারি করছিলো এই ঘটনার। হঠাৎ অজ্ঞাত এক ব্যাক্তি পুলিশ দলের মধ্যে এক বোমের বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বিস্ফোরণে মেথিয়াস জে ডিগান নামের এক পুলিশ সদস্যসহ আরোকিছু পুলিশ সদস্য তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন। পুলিশ বাহিনী নিরীহ শ্রমিকদের ওপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরুকরে। পুলিশের এই অতর্কিতে হামলায় প্রায় ১০থেকে ১২জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহিত হন। পুলিশ বাহিনী শ্ৰমিক আন্দোলনকে কৌশলে দাঙ্গা হিসেবে আখ্যায়িত করে পুরো দোষ চাপিয়ে দেয় নিরীহ শ্রমিকদের ওপর। পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করে অগাস্ট স্পীজ নামক ওই শ্রমিক নেতাসহ মোট আট জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং অগাস্ট স্পীজসহো মোট ছয় জনকে ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর তারিখে ফাঁসির দেওয়া হয় । ফাঁসিতে ঝোঁলানোর আগমুহূর্তে অগাস্ট স্পীজ বলেছিলেন যে "সেই দিন আসবে যখন আমাদের নিরাবতা আজ আপনারা যে আওয়াজ তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে"। ইতিহাস সাক্ষী অগাস্ট স্পীজ বলে যাওয়া সেই বাণীই আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই সম্মেলনে রেমন্ড লাভিনে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে পালনের প্রস্তাব পেশ করেন।
অবশেষে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠনকে মে মাসের ১ তারিখে বাধ্যতামুলুকভাবে কাজ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং এই দিনকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানানো হয়। আজ বিশ্বের ৮০টি দেশে শ্রম দিবস সরকারিভাবে পালন করা হয়। তবে বিশ্বের ৮০টি দেশেই যে ১লা মে তে সরকারিভাবে শ্রম দিবস পালন করে তা কিন্তু নয় ৷ সবচেয়ে মজার বিষয় এই যে খোদ আমেরিকাতে ১লা মে শ্রম দিবস পালিত হয় না। আমেরিকাতে শ্রম দিবস পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখে। ১৮৯৪সাল থেকে কানাডাতে শ্রম দিবস পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবারে । কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন স্পারও ডেভিড হামসন সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার সরকারি ভাবে শ্রমদিবস পালনের ঘোষণা দেন।
১৯২৩ সালে ভারতের চেন্নাই প্রথম মে দিবস উদযাপন করা হয়। ভারতের লেবার কিষাণ পার্টির বলিষ্ট নেতা সিঙ্গারা ভেলু চেত্তারায় এর উদ্যোগে ভারতের মাদ্রাজের দুইটি ভিন্ন স্থানে উদযাপিত হয় শ্রমিক দিবস। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় প্রথম মে দিবস পালন করা হয় ১৯২৭ সালে।দেশ বিভাগের পূর্বে ১৯৩৮ সালে নারায়ণগঞ্জে স্বল্পপরিসরে মে দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো । ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বাংলাদেশের শ্রমিকরা প্রথমবারের মতো বিপুল উৎসাহ নিয়ে মে দিবস পালন করে। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে ১ মে দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণার দাবি তোলে শ্রমিকরা । ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয় । ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর শ্রমিকদের বিরাট অংশ বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে এবং ওই সময়ে মে দিবস পালনে ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ করা যায় শ্রমিকদের মধ্যে। এমনকি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে স্বল্পপরিসরে মে দিবস পালন করা হয় । বাংলাদেশ স্বাধীন হলে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও তৎকালীন সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মে দিবসকে রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি দেন এবং সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন। তিনি ১৯৭২ সালের মহান মে দিবসে মহান মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলেধরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ
ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি