English

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় আলোকিত হোক শিক্ষাঙ্গণ

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় আলোকিত হোক শিক্ষাঙ্গণ
মতামত
ফারজানা অনন্যা

'শিক্ষকতা' শুধু একটি পেশা নয়, বরং এটি একটি জীবনব্রতের নামও বটে! আমাদের সমাজে বহুল ব্যবহৃত একটি কথা হলো, "পিতা-মাতা সন্তানকে জন্ম দিলেও, তাদের 'মানুষ' হিসেবে গড়ার কারিগর শিক্ষকরাই।" একজন শিক্ষার্থীর মননের দ্বিতীয় জন্ম শিক্ষাগুরুর কাছে। শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা, ব্যক্তিত্বের জাগরণ, মেধার উৎকর্ষতা সাধন করে তাদের জীবন আলোকিত করে তোলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। আলোকিত এবং মানবিক সমাজ গঠনের মূল চালিকাশক্তি ও দক্ষ কারিগর তিনি। একজন শিক্ষকের ছাত্র-ছাত্রীরাই রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন।  শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্বপ্নের বীজ বুনে দেন একজন শিক্ষক। তাই আমাদের সমাজে শিক্ষকদের স্থান অনেক উঁচুতে। শিক্ষক যেখানেই যান, সেখানেই তিনি সম্মানের আসনে অলংকৃত হয়ে থাকেন।

কিন্তু বর্তমান অস্থির সময়ে বাস্তবতা অনেকটা পাল্টে গিয়েছে। আমাদের সমাজে ধরেছে ক্ষমতার পচন। ইদানীং সব ঘটনাকে ছাপিয়ে একটি বিষয় প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় দেখতে পাই, দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষকগণ কমিটির সদস্যদের হাতে, তথাকথিত ছাত্রনেতাদের হাতে, অভিভাবকের হাতে, এমনকি শিক্ষার্থীদের হাতেও নিগৃহীত হচ্ছেন, লাঞ্চিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন।

এটা কেমন কথা? একজন শিক্ষক, তা তিনি যেকোনো পর্যায়ের হোন, যেকোনো বিষয়ের হোন, তিনি শিক্ষকই। তাঁর শরীরে মানুষ কীভাবে আঘাত করে? আর রাষ্ট্র ও সমাজ সেসব নিয়ে আবার রাজনীতি করে! বিচার না করে কালক্ষেপণ করে! শিক্ষকদের সম্মান প্রদশর্ন করাই ছিলো যুগ যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ রীতি। আজকের পশ্চিমা দুনিয়ায় শিক্ষকদের সম্মান অনেক বেড়েছে। আর শিক্ষকদের শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার কথা তো তারা কল্পনাও করতে পারে না। তাহলে আমাদের সমাজ আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?

বিগত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া শিক্ষক লাঞ্চনার বেশ কয়েকটি ঘটনা আমাদের অবক্ষয়িত সমাজের রূপটিকেই চোখের সামনে তুলে ধরে। এসব ঘটনার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কী হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের? কীভাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম সভ্যতাকে, জাতিকে টিকিয়ে রাখবে? যেখানে মানুষ গড়ার কারিগরদের পদে পদে অপদস্থ হতে হচ্ছে সমাজের বখাটেদের কাছে! এ বছরের বিগত ৩০ মার্চ শরীয়তপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের একটি ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের হাতে বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের অপমানিত ও প্রহৃত হওয়া, গত ১৩ এপ্রিল গাইবান্ধা সরকারি কলেজের কতিপয় বখাটেদের হাতে অধ্যক্ষ মহোদয়ের লাঞ্চিত হওয়া কিংবা হৃদয় মন্ডল নামে একজন শিক্ষকের ১৯ দিন কারাগারে থাকার পর মুক্তি পাওয়ার ঘটনাসহ অন্যান্য ঘটনাগুলো আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া সমাজে শিক্ষকদের ভঙ্গুর অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। আর পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ না দেওয়ার অপরাধে সারা দেশেই হেনস্তা করা হচ্ছে বহু শিক্ষককে। এসব কারণে  নিরাপত্তাহীনতায় ইতোমধ্যেই শিক্ষক সমাজের আত্মসম্মানবোধ ও দায়িত্ববোধে চিড় ধরে গিয়েছে।

ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ক্রমেই আলগা হচ্ছে। যত সম্পর্ক ঢিলা হচ্ছে, তত শ্রদ্ধা- ভক্তি কমছে। সেই বাদশা আলমগীরের মতো এখন আর শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালার মতো অবস্থা নেই! তার জন্য কেউ এককভাবে দায়ী নয়। পুরো সমাজ ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে দায়ী। যখন আমি আমার সন্তানকে কাউকে সম্মান করাতে শেখাতে পারিনি তখন সে তার শিক্ষককেও অসম্মান করবে। একজন শিক্ষকের যে তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের শাসন করার অধিকার আছে সেই বোধটাই সমাজ থেকে হারিয়ে গিয়েছে।

শিক্ষকগণকেও মনে রাখতে হবে, আমরা শিক্ষকরা নিজেদেরকে শিক্ষার্থীদের কাছে যতটা প্রাঞ্জল ও হাসিখুশি মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারব ,তাদের কাছ থেকে তার চেয়েও বেশি হাসিখুশি প্রফুল্ল মন আমরা দেখতে পাব। শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সবসময়ই অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ নেওয়া ঠিক হবে না। যখন পরীক্ষার আগে অস্থিরতা কাজ করে তখন চিন্তা ভুলে হাসতে পারার কৌশলটাও শিখাতে হবে তাদের। তাহলে পরিবেশ হালকা হবে, যা শিখন-শেখানো পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে। কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের নিকট কারাগারের মতো মনে হয়। শিক্ষার্থীরা সেখানে কথা বলতে পারে না, আনন্দ করতে পারে না। কঠিন শাসন, পান থেকে চুন খসলে ধমক, তিরস্কার, লজ্জা দেওয়া ও শারীরিক শাস্তি প্রদান করা হয়। আবার কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যেখানে নিয়ম-কানুনের কোনো বালাই নেই। শিক্ষকদের কথা শিক্ষার্থীরা শোনে না, শিক্ষার্থীরা যা ইচ্ছে তাই করে। শিক্ষকদের কোনো ধরনের সম্মান প্রদর্শন করে না। এবং প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে খুব হালকাভাবে দেখে। এরকম উভয় পরিস্থিতিই কিন্তু চরম ক্ষতিকারক। এই অবস্থা যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজ করে সেখানে পড়াশুনা হয় না, শিখন-শেখানো পরিবেশ থাকে করে না।

আমাদের সংসদে অনেক কিছুই আলোচনা হয়, একজন শিক্ষক হিসেবে আমি অনুরোধ করব একটি আইন যাতে পাস করা হয় যে, কোনো পর্যায়ের কোনো শিক্ষককে কেউ যেন শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করতে না পারে, কেউ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইন হাতে তুলে নিতে না পারে, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন। যদি কেউ এসব করার চেষ্টাও করে সেটি হবে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সর্বাগ্রে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সমাজ ও পারিবারিকভাবে শিশুদের নৈতিক এবং বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে হবে৷ তা না হলে সমাজে যেভাবে পচন ধরেছে, তাতে এ সমাজকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই পচন দূর করতে হলে শিক্ষকের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষকতা একটি জীবনদর্শনের পাশাপাশি এটি জীবন নির্বাহের একটি মাধ্যম। শিক্ষককে এই পেশা থেকে উপার্জিত আয় দ্বারা তার নিজের এবং পরিবারের ব্যায়ভার বহন করতে হয়। শিক্ষকের আর্থিক স্বচ্ছলতার বিষয়টি নিশ্চিত করলে, প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্য এমনিতেই বন্ধ হবে। ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা শিক্ষাব্যবস্থায় মেধাবীদের অংশগ্রহণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর আমাদের শিক্ষকসমাজের কর্মপরিবেশ এবং কর্মসন্তুষ্টির মাত্রার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। একটি দেশের শিক্ষকের মর্যাদা বাড়লে সে দেশের শিক্ষার গুণগত মান যেমন বাড়ে, আবার ঠিক একইভাবে শিক্ষার গুণগত মান বাড়লেও তা শিক্ষকের মর্যাদাকে বাড়ায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আগে শিক্ষকের মর্যাদা বাড়াবে, না শিক্ষক আগে গুণগত শিক্ষাদান করবেন, সেটা নিয়ে তর্ক করলে তা অনেকটা "ডিম আগে না মুরগি আগে"র মতো অমীমাংসিত রয়ে যাবে। আমাদের কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। এখান থেকেই শুরু হোক।

আবার শিক্ষকদের একটি শ্রেণির নানান কর্ম ও দায়িত্বহীনতার কারণেও শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গাটি ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক এক জরিপেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনোমিক্স অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ এবং ভারকি ফাউন্ডেশনের ‘গ্লোবাল টিসার্চ স্ট্যাটাস ইনডেক্স-২০১৮’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে গড়ে মাত্র ৩৬ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী তাদের শিক্ষকদের সম্মান করে। অর্থাৎ ৬৪ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী তাদের শিক্ষকদের সম্মান করে না। এই ভয়াবহ অবস্থা দূরীকরণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে  নৈতিক জাগরণের পাশাপাশি শিক্ষকদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। তাঁদের নিজ দায়িত্বের প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পাঠদান, শিক্ষার্থীদের  মানবিক গুণাবলিতে গড়ে তোলা, কর্মক্ষেত্রে বাণিজ্যিক মনোভাব পোষণ না করা, সততা বজায় রাখা সহ বিভিন্ন ইতিবাচক কার্যক্রমের দ্বারা নিজেদের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং রেষারেষিরও অবসান ঘটাতে হবে। শিক্ষকদের পরস্পরের প্রতি প্রকাশ্য দ্বন্দ্বও তাঁদের প্রতি শিক্ষার্থীদের বীতশ্রদ্ধ করে তোলে।

আমাদের শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। শিক্ষকদের মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক দিকটি নিশ্চিত করলে এই পেশায় সর্বোচ্চ মেধাবীদের আগ্রহ তৈরি হবে। যারা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং নিজ বিষয়ে দক্ষ।

প্রতি বছর ৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক "শিক্ষক দিবস" আসে। আড়ম্বরের সাথে পালিত হয় দিবসটি। শিক্ষার্থীরা তাদের অতি প্রিয় শিক্ষকদের ফুল, কার্ড, চিঠিসহ বিভিন্ন উপহার দিয়ে ভালোবাসা জানায়। শিক্ষকরাও স্নেহে সিক্ত করেন শিক্ষার্থীদের। অবশ্যই বিষয়টি ভীষণ আনন্দদায়ক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য। কিন্তু তাতে মোটেও প্রতিবছর শিক্ষকদের সাথে ঘটে যাওয়া অবমাননাকর ঘটনাগুলোর হেরফের হয় কি? শিক্ষক দিবস বছরে একদিন নয়, বরং শিক্ষকদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দিন হোক বছরের ৩৬৫ দিন, এ বার্তাই বুনে দিতে হবে সবুজ পাতার মতো সতেজ শিক্ষার্থীদের মাঝে।

আমি নিজে একজন শিক্ষক। আমাকে শিক্ষক হবার, সৎ হবার, আলোকিত মানুষ হবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন আমার শিক্ষকরা। আমার শিক্ষকরা শুধু আমার শিক্ষক নন, আমার জীবনের সবচাইতে  শ্রদ্ধার ও আস্থার মানুষ তাঁরা। আমি আমার শিক্ষকদের যে কী ভীষণ পরিমাণ ভালোবাসি, তা আমি কোনোদিনও পৃথিবীর কোনো ভাষায় লিখে প্রকাশ করতে পারবো না৷ আমার মননের শক্তি ও সাহস তাঁরা। আমি আমার শিক্ষকদের থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি ও পাচ্ছি প্রতিনিয়ত, তারও ঋণশোধ অসম্ভব। শিক্ষকরা যেমন ভালোবাসবেন, তেমনি সাথে শাসন করে আমাকে সঠিক পথে আনার অধিকারও তাঁদের আছে, এ বিষয়টি আজীবন মনে রেখেছি। এবং বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদেরও মনে রাখা উচিত বলে মনে করি।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার যুগলবন্দিতে আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গণ হয়ে উঠুক আবার আলোকিত ও মুখরিত। লাইব্রেরিতে থাকুক শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের পদচারণা। শ্রেণিকক্ষে থাকুক শিক্ষকের নির্ভয় কণ্ঠধ্বনি। শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তার্জাতিক সাফল্য অর্জন করুক আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দেশের জন্য বয়ে আনুক গর্ব। এটা আমার স্বপ্ন আর আমাদের সকলের স্বপ্ন।



লেখক: প্রভাষক, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ ।


সিটিজেন টাইমস্/ফারজানা অনন্যা/এমই