আজকাল আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে এবং সংবাদ শিরোনামে স্থান পায়। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তরুণ-তরুণীরা এই প্রবণতায় জড়িত হন বেশি। সাথে সাথে উচ্চপদের কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, কর্মজীবী, দিনমজুর, ব্যবসায়ীগণ মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে থাকে। যদিও আত্মহত্যা একটি ভয়ংকর অপরাধ ও মানসিক ব্যাধি। আত্মহত্যা শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিতে নয়, সমাজের দৃষ্টিতেও গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ। পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়জনিত নানা কারণে স্বাভাবিক মৃত্যুকে না মেনে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা ও মানসিক বেদনা ও অর্থনৈতিক দৈন্যতা বেড়ে গেলে চরম হতাশা কাজ করে। হতাশাই নিজের মধ্যে নেতিবাচক ধারণাগুলো তৈরি করে। এক পর্যায়ে মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। নিজেকে ও নিজের জীবনকে ব্যর্থ মনে হয়। তখনই মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। একাজ যারা করে তাদেরকে আত্মঘাতক বা আত্মহনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আসলে আত্মহত্যা কোন সমস্যার চুড়ান্ত সমাধান নয়, বরং জীবন মহামূল্যবান এবং এটিকে উপভোগ করা উচিৎ।
সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন গতবছর আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে একটি গবেষণা চালিয়েছিল। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। তাদের মধ্যে ৬৫ জন ছাত্র, অর্থাৎ আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৩৬ শতাংশই ছাত্র। ছাত্রীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ছাত্র গত বছর আত্মহত্যা করেছে। দেশের প্রায় ৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের আত্মহত্যার হার বেড়েছে। তাদের মধ্যে সম্পর্কগত কারণে ২৪.৭৫ শতাংশ, পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯.৮০ শতাংশ, পড়াশোনা সংক্রান্ত কারণে ১০.৮৯ শতাংশ, আর্থিক সমস্যায় পড়ে ৪.৯৫ শতাংশ আর মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। আত্মহত্যার কারণের মধ্যে আরও উঠে এসেছে,১.৯৮ শতাংশ মাদকাসক্ত হয়ে নির্বিকারে নিজের জীবন হননের পথ বেছে নিয়েছে এবং আরও ২১.৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী নানাবিধ কারণে আত্মহত্যা করেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে, যা ৬১.৩৯ শতাংশ বা ৬২ জন। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ জন, যা মোট আত্মহননকারীর ১১.৮৮ শতাংশ। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন, যা মোট আত্মহত্যাকারীর ৩.৯৬ শতাংশ। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২২.৭৭ শতাংশ, যা সংখ্যায় ২৩ জন। গতবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ জন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, যাদের সংখ্যা ৩ জন। এসব চিত্র নিঃসন্দেহে ভীতিকর ও উদ্বেগজনক।
প্রতিষ্ঠানটি তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে বলছে, অনার্স পড়ুয়া তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলক বেশি, যা ৩৬.৬৩ শতাংশ। ধারণা করা হয়, এ শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক সামাজিক চাপ বেশি থাকে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মাঝে হতাশার ছাপ বেশি দেখা যায়। গবেষণায় ২২-২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি বলে উঠে এসেছে। সমন্বয়কৃত তথ্যগুলোর মধ্যে ৬০টি আত্মহত্যার ঘটনা এই বয়সসীমার শিক্ষার্থীদের মধ্যে হয়েছে, যা মোট ঘটনার ৫৯.৪১ শতাংশ। অন্যদিকে, ১৮-২১ বছর বয়সী তরুণদের আত্মহত্যার ঘটনা মোট সমন্বয়কৃত ঘটনার ২৬.৭৩ শতাংশ বা ২৭ জন। এ ছাড়া ২৬-২৯ বছর এবং ২৯ বছরের ঊর্ধ্বে এই হার যথাক্রমে ৯.৯০ শতাংশ এবং ৩.৯৬ শতাংশ, যা সংখ্যায় যথাক্রমে ১০টি ও ৪টি। সাধারণত ছাত্রীদের মাঝে আত্মহত্যার হার বেশি দেখা গেলেও এবারের সমন্বয়কৃত তথ্য থেকে দেখা যায়, গতবছর আত্মহত্যাকারীদের একটা বড় অংশই ছিল ছাত্র। মোট ৬৫ জন ছাত্র আত্মহত্যা করেন, যা মোট শিক্ষার্থীর ৬৪.৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ছিল ৩৬ জন বা ৩৫.৬৪ শতাংশ।
জানা যায় পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় দশ লাখ লোক আত্মহত্যা করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে আমাদের দেশে প্রতি বছর দশ হাজারের অধিক মানুষ এই পথে পা বাড়ায়। উক্ত সংস্থাটির মতে সারা বিশ্বে অত্মহত্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তেরোতম। আর আত্মহত্যার চিন্তায় মনঃস্তাত্ত্বিক রোগে ভোগে বিশ্বে প্রায় দশ কোটি মানুষ। ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি উদ্বেগজনক তথ্য উপস্থাপন করেছে। সেখানে দেখা যায়, পুরো ২০২০ সালটি ছিল কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের বছর এবং বিশ্বব্যাপী এতো মৃত্যুর মিছিল আর কোনো মহামারীতে দেখেনি কখনো। বিবিএস বলছে, ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৫ হাজার ২ জন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে উক্ত নয় মাসে আত্মহত্যায় মারা গেছেন ১১ হাজার মানুষ। অর্থ্যাৎ করোনার চাইতে আত্মহত্যায় মৃত্যুর হার দ্বিগুণ। অন্যদিকে বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য মতে, পূর্বের বছর গুলোতেও এই প্রবণতা ছিল উদ্বেগজনক। ২০১৮ সালে ১১ হাজারের অধিক, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ১১ হাজার ৯৫ জন, ২০১৬ সালে ১০ হাজার ৬০০ জন, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৫০০ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছিল। উক্ত হিসাবকে দৈনিক ভাগ করলে গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে।
বর্তমান যুগ হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। তাই আত্মহত্যার প্রবণতাতেও যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন কারণ। বিশেষত ব্যক্তি বিশেষের মানসিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতাও আত্মহত্যার কারণ হতে পারে। দৈনন্দিন জীবনের নানা জটিলতা ও প্রযুক্তির প্রতি মানুষের অত্যধিক আসক্তি বাড়লেও আত্মহত্যার প্রবণতার মধ্যে খুব পরিবর্তন হয়নি। মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাগুলো দুর্বল হয়ে গেলে মানুষ অসহায় বোধ করে এবং এক পর্যায়ে আত্মহত্যা করে ফেলে। পৃথিবীজুড়ে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ আত্মহত্যা। যারা মনের দিক থেকে দুর্বল, ধৈর্য ও সহ্য ক্ষমতা যাদের কম অবসাদ ও হেনস্থার শিকার হয়ে এবং হঠাৎ কোনো পরিবর্তনের সাথে সহনশীল হতে না পেরে বিপদগামী হয়। অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় মানসিক চাপ। এই চাপ সহ্য করতে না পারলে মানুষটি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে এই পথ বেছে নেন।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে আঁচল ফাউন্ডেশন দশটি প্রস্তাব সুপারিশ করেছে। প্রতিটি জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে মেন্টাল হেলথ প্রফেশনাল নিয়োগ দেওয়া এবং ইয়ুথ অর্গানাইজেশনকে যথাযথ ট্রেনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে। নীতি নির্ধারণী সংলাপে তরুণদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পুরোপুরি দেশের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনা। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও সেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করা। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কুসংস্কার ও হীনমন্যতা দূরীকরণে প্রাথমিক স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহে জরুরি ভিত্তিতে একটি জাতীয় হটলাইন সেবা চালু করা। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে সরকার একটি বিশেষ অ্যাপস চালু করতে পারে যেন যে কেউ দ্রুত মনোবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারে। প্রান্তিক পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং তরুণদের মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড ট্রেনিং সরবরাহ করা। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে যুগপৎভাবে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন আয়োজন করা। সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ভূমিকা জোরদার করা এবং মানসিক চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ ফি ও ওষুধের দাম কমানো।
আত্মহত্যা’ সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দনীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ‘কাজ’। আত্মহত্যার চেয়ে ভয়ংকর বিব্রতকর এবং কষ্টকর কোনো প্রেক্ষাপট সমাজে আর একটিও নেই। কিন্তু তার পরও ঘটনাটি ঘটে এবং বলা যায় হরহামেশাই ঘটে। আজকের তরুণরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ ও কান্ডারি। তারা নানা স্বপ্নের জালবুনে, লেখাপড়া করে কাঙ্ক্ষিত কিছু অর্জন করতে চায়, পৃথিবীকে আলোকিত করতে চায়। অধিকাংশই লেখাপড়া শেষ করে একটি ভাল কর্মসংস্থান, পরিবারের জন্য কিছু করার তাগিদ, অনেকে প্রিয়জনকে জীবন সঙ্গী করে একটি সুন্দর সংসারের জালবুনে এবং এগুলোর যেকোন একটিতে কোন ছেদ পড়লে সে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়। নিজেকে ব্যর্থ মনে করে এবং জীবনকে মূল্যহীন মনে হয়। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, করোনাকালীন সময়ে বেকারত্ব সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। লক্ষ লক্ষ তরুণ তরুণী কোন কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান খুঁজে পাচ্ছে না, এ কারণে তাদের মধ্যে হতাশা চরমভাবে আকড়ে ধরছে। ফলে তারা পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দনীয় ও নিকৃষ্টতর কাজটিই বেছে নিচ্ছে। আসলে আত্মহত্যা কোন সমস্যার চুড়ান্ত সমাধান নয়, বরং উপলব্ধি করা উচিত জীবন মহামূল্যবান এবং জীবন প্রদীপ শেষ করার আগে এটিকে ভালভাবে উপভোগ করা উচিৎ।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট ।