English

ধানের পর গম নিয়েও বাড়ছে শঙ্কা

ধানের পর গম নিয়েও বাড়ছে শঙ্কা
কৃষি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রাকৃতিক দুর্যোগে চলতি বছর বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে দেশের বোরো আবাদে। বিশেষ করে পাহাড়ি ঢলে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাওরের ধান। যার জেরে চালের দাম বাড়া নিয়ে থাকছে শঙ্কা। চালের দাম বাড়লে চাপ পড়ে বিকল্প উৎস গমের ওপর। সেই গমও নেই স্বস্তির জায়গায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব বাজারে গমের দাম আগে থেকেই চড়া। এর মধ্যে আবার গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। এতে বিশ্ব বাজারে আরেক দফা বেড়ে অবস্থান করছে সর্বোচ্চ দামে। ভারতের এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বাংলাদেশ না থাকলেও পরোক্ষভাবে এর প্রভাব থেকেই যাচ্ছে। এরই মধ্যে হু হু করে বাড়া শুরু করেছে আটার দাম।

সরকারি হিসাবে এবার হাওরে বাঁধ ভেঙে সাত জেলায় হাজার ৭শ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি সারাদেশে কয়েক দফা ঝড় ও ধান কাটা মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে অতিবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেতের ধান। এছাড়া কয়েকটি জেলায় বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ব্লাস্টসহ অজানা রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। সবমিলে এবার ফলন কমেছে ধানের।

অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ওই দুই দেশ থেকে গম আমদানি করতে পারছে না বাংলাদেশ। গত শুক্রবার (১৪ মে) বিশ্বের অন্যতম গম রপ্তানিকারক দেশ ভারত রপ্তানি বন্ধ (প্রতিবেশী দেশ বাদে) ঘোষণার পর অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে দেশের আটা-ময়দার বাজার। এ সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদি হলে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও বাড়বে দাম। বাংলাদেশে খাদ্যশস্য জোগানের জন্যও হবে বড় দুশ্চিন্তার কারণ। চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ গম এসেছে ভারত থেকে।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এখন খাদ্যশস্য পরিস্থিতি ভালো নয়। অত্যন্ত নাজুক। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে বড় ভূমিকা নিতে হবে।

এখন প্রধান খাদ্যশস্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের সার্বিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। দ্রুত সব ধরনের ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ অন্য বাধাগুলো স্থগিত করা দরকার। বিকল্প বাজার ধরতে তাদের সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে।ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, বিষয়টি জরুরি বলে বিবেচনা করতে হবে। কারণ শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ববাজারে খাদ্য নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে গমের দাম সারাবিশ্বে বাড়ছে। সেই চাপটা স্বাভাবিকভাবে সবখানে পড়বে।

 

তিনি আরও বলেন, এবছর দেশে সম্ভাব্য পুরোটা গম উৎপাদন করা দরকার। কৃষকের সার-বীজসহ অন্যান্য সহায়তার পাশাপাশি গমের আগাম মূল্য নির্ধারণ করে ভালো মুনাফা দেওয়া দরকার। সরকারি চালের সংগ্রহ ও মজুত বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি মিলারদের কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। যেন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংকট না তৈরি হয়।

ধানের ক্ষতি সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি

কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, শুধু হাওরে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সাত জেলায় ৯ হাজার ৭শ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষদের দাবি, শুধু সুনামগঞ্জে ৩১টি হাওরের ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়েছে। অন্যান্য জেলা মিলে এ ক্ষতি আরও কয়েকগুণ হবে।এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় অতিবৃষ্টি ও কয়েকটি ছোট ছোট ঝড়ে ধান পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও পরিপক্ব অবস্থায় তলিয়ে গেছে। এসব জেলায় বিঘাপ্রতি ফলন কমেছে বেশ কিছুটা।দেশের অন্যতম ধান উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁর হোগলবাড়ি গ্রামের কৃষক হারুনুর রশিদ বলেন, ২৯ এপ্রিল ঝড়ে ধান গাছ পড়ে যাওয়ার কারণে সে সময় পরিপক্ব ধান ঝরে যায়। এতে বিঘাপ্রতি ফলন এবছর প্রায় দুই থেকে তিন মণ কমেছে।সদরের বোয়ালিয়া গ্রামের চাষি রাকিবুল ও শরিফুল বলেন, গত বছর যে জমিতে বিঘাপ্রতি ২২ থেকে ২৫ মণ ধান হয়েছে, সেসব জমিতে এবার ১৫ থেকে ১৭ মণের বেশি ফলন হচ্ছে না।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে সারাদেশে বৃষ্টিতে মোট ক্ষতির চূড়ান্ত তথ্য নেই। সংস্থাটির তথ্যমতে, এবছর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর। এর বিপরীতে বোরো আবাদ হয়েছে ৪৯ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলে এবছর উৎপাদন আরও বাড়বে।

চাল হবে কম, নতুন সমস্যা অপুষ্ট ধান

দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে এরই মধ্যে বোরো ধান বেচাকেনা শুরু হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন বাজারে সরবরাহ কিছুটা কম। ভালোমানের ধানের দাম চড়া।অন্যদিকে ওইসব বাজারে অপুষ্ট ধানের সরবরাহ বেড়েছে। অর্থাৎ বন্যা ও বৃষ্টির শঙ্কায় আগাম কাটা। এসব ধান চালে পরিণত করলে উৎপাদন বেশ কমবে। তড়িঘড়ি কেটে তোলা এ ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষ।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত এক বছরে আটার দাম কেজিতে বেড়েছে ৬ থেকে ১৩ টাকা এবং ময়দায় বেড়েছে ১৮ থেকে ২৪ টাকা পর্যন্ত। বিবিএসের হিসাবে, বর্তমানে দেশে গমের মোট চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ থেকে ৭০ লাখের মধ্যে, যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট ১০ লাখ টন উৎপাদন হয়েছিল। এর আগের বছরের উৎপাদনও প্রায় সমপরিমাণ।

 বিশাল এ ঘাটতি পূরণে ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারিভাবে ৪ লাখ ৭৮ হাজার টন ও বেসরকারিভাবে ৪৮ লাখ ৬৪ হাজার টন গম আমদানির তথ্য দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।