English

বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু

বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু
মতামত
ডিসেম্বর, ১৯৯৬। জীবনের প্রথম উত্তরবঙ্গ সফরশেষে ঢাকায় ফিরছিলাম। তখন তো মোবাইল ছিল না। আমার হাতে ঘড়িও ছিল না। শীতের পড়ন্ত বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেট থেকে রওনা করে নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছার পর এশার আযান হয়। ঘাটে বাস-ট্রাকের দীর্ঘ সারি। একাই ভ্রমণ করছিলাম। ঠগ-বাটপারের খপ্পরেই পড়ি কিনা ভেবে পেটে ক্ষুধা নিয়ে বাসেই বসে থাকি। কখনো ঝিমুনি আসে, আসে তন্দ্রা। ফেরিঘাটের নৈমিত্তিক হইচইসহ নানা রকম শব্দে ঘুমানোর উপায়ও নেই। মনে পড়ে, আমাদের বাস যখন ফেরিতে মাঝ নদীতে তখন দূরের মসজিদের মাইক থেকে থেকে ভেসে আসছিল ফযরের আযান। এভাবে সারাটি রাত কেটে গিয়েছিল ফেরি পাড় হতে। এর দেড় বছর পর ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু। একটি সেতুর কারণে বদলে গেছে গোটা উত্তরবঙ্গের জনজীবন। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছে লাখে লাখে মানুষ। শস্যাবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়েছে কৃষিজমিতে। ফল, ফসল, সবজি থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গে উৎপাদিত সব ধরনের পণ্য ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। গতি সঞ্চার হয়েছে দেশের অর্থনীতিতে।

 রো রো ফেরিতে কেবল পদ্মা নদী পাড়ি দিতে লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। কিন্তু ফেরিতে উঠার সিরিয়ালের অপেক্ষা? দুই-তিন ঘণ্টা থেকে সাত-আট ঘণ্টা। ঈদসহ বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে কখনো তার চেয়েও বেশি সময় কেটে যায় ফেরিঘাটে। ফেরির অপেক্ষায় ঢাকার হাসপাতালে রেফার করা কত মুমূর্ষু রোগী প্রাণ ত্যাগ করেছে পদ্মার ওপার! আবার আবহাওয়ার মর্জি ভালো না থাকলে অনিশ্চয়তার শেষ নেই। কখনো দুই-তিন দিনও বন্ধ থাকে ফেরি সার্ভিস। এ রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে আর যাই হোক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে পারে না। এছাড়াও নদী পারাপারে ফেরি দুর্ঘটনাসহ নৌডুবিতে কত প্রাণহানির ঘটনাই না ঘটেছে। এখানেই পদ্মা সেতুর গুরুত্ব নিহিত।    
 
যমুনা সেতুর চেয়েও আরো বেশি সম্ভাবনা নিয়ে জাতির জন্য উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। এপারে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া আর ওপারে শরীয়তপুরের জাজিরা। দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৮ দশমিক ১০ মিটার। ২৫ শে জুন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। যমুনা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার আগে পদ্মার ওপর সেতুর কথা কারো মাথায় আসেনি। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় বসেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৯ সালেই হয় প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ।

স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ফলে সরাসরি উপকৃত হবে তিন বিভাগের ২১ জেলার মানুষ। এগুলো হলো খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা; বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী। বহু পথ ঘুরে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে কোনো কোনো জেলার ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। পদ্মা সেতু খুলে দিলে চাপ কমবে পাটুরিয়া ঘাট ও যমুনা সেতুর ওপর। এই প্রথম শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরসহ আরো কয়েকটি জেলার সঙ্গে ঢাকার সরাসারি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর দূরত্বও কমে যাবে বহুলাংশে। ঢাকা থেকে বরিশালের দূরত্বই কমবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। ঢাকার গাবতলী থেকে আরিচা হয়ে বরিশালের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। সায়েদাবাদ থেকে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে এই শহরটির দূরত্ব হবে ১৫৬ কিলোমিটার। আবার গাবতলী থেকে আরিচা হয়ে ঝিনাইদহ-যশোর হয়ে খুলনার দূরত্ব ২৯২ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুর রুটে হবে ২৪৭ কিলোমিটার।  বরিশাল থেকে তিন ঘণ্টায়, খুলনা থেকে চার ঘণ্টায়, ফরিদপুর থেকে দুই ঘণ্টায়, যশোর থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যেই রাজধানীতে পৌঁছানো যাবে।

কেবল মানুষের চলাচলে স্বাচ্ছন্দ্যই নয়, মালামাল পরিবহণেও আসছে গতি। যশোরের বেনাপোল স্থল বন্দর, সাতক্ষীরার ভোমরা স্থল বন্দর, বাগেরহাটের মংলা বন্দর, পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের পণ্য ঢাকা ও অন্যান্য শহরে পৌছে যাবে সহজেই। মংলা ও পায়র বন্দরের কারণে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ভারী শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টির কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। মংলা বন্দর এলাকায় বেশ কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ইতোমধ্যেই চালু হয়েছে এবং গড়ে উঠছে গার্মেন্টসসহ রফতানিমুখী শিল্প। একদিকে বন্দর আর অন্যদিকে ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগে সময় কমে আসা পুরো অঞ্চলের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ওপরও চাপ কমবে।

খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ ও শরীয়তপুরের মাছ, যশোরের সবজি আর ফুল, বরিশালের ধান ও পান, সাতক্ষীরার আম-লিচুসহ অন্যান্য ফলফলাদি ও মুরগি সহজেই পৌঁছবে ঢাকায়। এসব এলাকার বহু পণ্য দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বাইরে যেত না। ঢাকার বাজারে বৃহত্তর ফরিদপুরের মাছ পাঠানোর কথা চিন্তাও করা হতো না। অথচ গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরের বিল ও নিম্নাঞ্চলগুলো মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য বিখ্যাত। সেতুর কারণে এসব জেলার সব ধরনের কৃষিপণ্য তাদের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত বাজারে দ্রুত যেতে পারবে। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম-সিলেটসহ বড় বড় জেলাশহরগুলোতেও এসব পণ্য প্রবেশের সুযোগ পেতে যাচ্ছে। যশোরের ফুল রাজধানীসহ সারাদেশে বাজারজাত করা হয়। দেশে ফুলের বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। সেতু চালু হলে বিদেশে ফুল রপ্তানিরও দ্বারোন্মোচন ঘটবে।  মোটকথা দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে কৃষিখাতে বড় ধরনের গতিশীলতা আসছে।  

পর্যটকদের কাছে বড় আকর্ষণের নাম সুন্দরবন ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রতি অদম্য আগ্রহ রয়েছে শিক্ষার্থী ও পর্যটকদের মাঝে। এতদিন আসা-যাওয়ার দীর্ঘ সময়ের ঝক্কি এবং অনিশ্চিত পদ্মা পাড়ি দেওয়ার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের অনেকেই সুন্দরবন ভ্রমণের উৎসাহ হারাতেন। পর্যটনের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে কুয়াকাটা-সুন্দরবন আর ‘দিল্লী দূর অস্ত’ থাকছে না। বাস্তবতা হলো, পর্যটন কেবল শহুরেদের মধ্যে আটকে নেই। এখন কিন্তু মধ্যাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের লোকজনও দল বেধে গাড়ি ভাড়া করে অহরহই কক্সবাজার, সিলেট যাওয়া আসা করছেন। তাদের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হবে সুন্দরবন ও কুয়াকাটা। আবার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লোকজন আগ্রহী হবেন পর্যটন বিস্ময় কক্সবাজার, পাহাড়-অরণ্যের লীলাভূমি সিলেট এবং ভাটির হাওর পরিদর্শনে। আর সারাদেশের মানুষ ছুটবে একবারের জন্য হলেও নিজের চোখে দেশের দীর্ঘতম সেতুটি দেখতে। দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জা পদ্মা সেতুকে আলোকিত করে রাখবে রাতেও। বিশেষ দিনগুলোতে সেতুর লাইটিং ছড়াবে আলোর ছটা। শুধু পদ্মাপারের মানুষ নয়, আলোকসজ্জা বা আর্কিটেকচারাল লাইটিং দেখার জন্য সারা দেশ থেকে ছুটে আসবে সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ।  সেতুর নানা বৈচিত্র্যের অন্যতম আকর্ষণ এই লাইটিং। ফলে সেতুকে কেন্দ্র করেও পর্যটন খাতে বিরাট প্রাণচাঞ্চল্যের সঞ্চার হবে।     

প্রমত্তা পদ্মার উপর সেতু নির্মাণে প্রাাকৃতিক চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। একে তো প্রবল স্রোত। তার ওপর ঢেউ। এদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে প্রকৌশলিদের। মাটির স্তর না পেয়ে পাইলিং করতে গিয়েও ছিল প্রতিবন্ধকতা। মূল নদীর মধ্যে ১৫০ মিটার পর পর বসানো হয়েছে ৪২টি পিলার। তবে সড়কের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে দুই প্রান্তে আরও অনেক খুঁটিই রয়েছে।  দুপাশে সড়কের সঙ্গে সংযোগ মিলিয়ে সেতুটি ৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। পদ্মা নদীর পানির স্তর থেকে ৫০ ফুট উঁচুতে বসানো হয়েছে প্রতিটি স্প্যান। একেকটি স্প্যানের দৈর্ঘ ১৫০ মিটার। স্প্যান বসেছে মোট ৪১টি। স্প্যানের  দৈর্ঘ্য ১০০ মিটারের বেশি হলে কনক্রিটের পরিবর্তে কাঠামোতে স্টিল ব্যবহার করা হয়। স্টিল কাঠামোর কারণে সেতুর ওজন কম হয়। ফলে ভূমিকম্পে তা ঘাত সহনীয় হয়। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও সেতুর কিছুই হবে না। নির্মাণকালে ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে সেতুতে স্টিলের স্প্যান বসানো হয়েছে। সবচেয়ে শক্তিশালী হাতুড়ি ব্যবহারের কথা আমরা জেনেছি পত্রপত্রিকায়। সেতুর স্থায়িত্ব হবে ১০০ বছরেরও বেশি। ব্যবহৃত টেকনিকে নতুনত্ব আছে বলেই পদ্মা সেতু স্টাডি করবেন প্রকৌশল বিষয়ের বিদেশি ছাত্র ও গবেষকগণ। এটি আমাদের জন্য গৌরবের। এটি দ্বিতল একটি সেতু। উপরে চার লেনের সড়কে চলবে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মোটর সাইকেল ইত্যাদি। আর নিচে থাকছে রেলপথ। যান চলাচল শুরু হওয়ার পর পর শুরু হবে সেতুতে রেললাইন স্থাপনের কাজ। সেতুতে টোলের হার এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যে ১৫-১৬ বছরের মধ্যেই নির্মাণ ব্যয় উঠে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল  সেতু পুরোপুরি চালু হলে দেশের জিডিপিতে এটি এক দশমিক দুই শতাংশ অবদান রাখবে। বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করছেন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে পদ্মা সেতুর অবদান দুই শতাংশের কাছাকাছি চলে যাবে।

এ সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয় বরং সারা দেশের সংযোগ সেতু। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে বাকি অংশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করছে এ সেতু। শেখ হাসিনার অনড় মনোভাবের কারণেই অনেক পানি ঘোলা হওয়ার পরও ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর শুরু হয় দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্পের নির্মাণ কাজ। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও চোখ রাঙানিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু  নির্মাণের মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রোজ্জ্বল হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার অবিসংবাদিত নেতৃত্বে প্রমাণিত হয়েছে ‘আমরাও পারি’। আত্মবিশ্বাসী ও প্রত্যয়ী রাষ্ট্রনেতা হিসেবে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু আমাদের স্বনির্ভরতার প্রতীক। এটি বাংলাদেশের একটি বড় সম্পদ। আমাদের অহংকার। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতীক।

লেখক: সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পিআইডি ঢাকা।


ডেল্টা টাইমস্/ইয়াকুব আলী/সিআর/এমই