English

কর্মজীবী নারীর গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা

কর্মজীবী নারীর গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা
ফিচার
জোসনে আরা বেগম, একজন গণমাধ্যমকর্মী। তিনি মা হতে চলেছেন। থাকেন ঢাকার রায়েরবাগ। অফিস মতিঝিলে। এ অবস্থা নিয়েই নিয়মিত অফিস করেন। জোসনে আরা জানান, ‘ঘর-সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সেরে, স্বামী-সন্তানের প্রয়োজন মিটিয়ে ঘরের বাইরে এসে নিজেকে মানিয়ে নেয়া কিছুটা কঠিন। নারী জীবনের এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে কর্মক্ষেত্রে কাজ করা অনেক কষ্ট সাধ্যতো বটেই।’

গর্ভাবস্থায় নারীর শরীরে অনেক পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন আসে চেহারায়ও। অনেকের চোখের নিচে কালি পড়ে যায়, আবার একটু বেশি সময় বসে থাকলে পা ফুলে যাওয়াসহ নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে।

 শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, নারীর জীবনে গর্ভকাল অন্য সময়ের চেয়ে আলাদা। এ সময় একই দেহে দু’টি প্রাণের বসত। জন্মদান প্রক্রিয়াও জটিল। আমাদের দেশে প্রসবকালে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার আগের তুলনায় অনেক কমেছে, কিন্তু এখনও যে পর্যায়ে আছে, তা উদ্বেগের। গর্ভকালীন মা’র বাড়তি যতœ নিতে হবে তার পরিবার থেকে। মায়ের ও অনাগত শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। কর্মজীবী নারীর গর্ভকালীন কোনো বিশেষ সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে জরুরিভাগে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। শরণাপন্ন হতে হবে মা ও শিশু চিকিৎসকের।

 গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবায় তৎপর প্রায় সবগুলো সরকারি হাসপাতাল। গর্ভকালীন টিটি টিকা, ওজন মাপা, স্বাস্থ্য শিক্ষা গ্রহণ, রক্তস্বল্পতা বা শরীরে রক্ত কম কি-না, তা পরীক্ষা করা, রক্তচাপ পরিমাপ করা, পা অথবা মুখ ফুলে গেলে পায়ে পানি আসে কি-না তা দেখা, শারীরিক অন্য কোনো অসুবিধা আছে কি-না, তা পরীক্ষা করা এবং নিয়মিত ডাক্তারি পরামর্শ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। এসব সুবিধা প্রায় বিনামূল্যে সকল সরকারি হাসপাতালে পাওয়া যায়।

কর্মজীবী নারীর গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবায় পুষ্টিকর খাদ্য প্রসঙ্গে ডায়েটিশিয়ানরা বলেন, যেসব নারী গর্ভাবস্থায় ও শৈশবকালে যথাযথ পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে, তাদের সন্তানরাও সমপরিমাণ পুষ্টি পায়, আর তাদের প্রসবকাল থাকে জটিলতামুক্ত। ওইসব শিশু স্বাভাবিক ওজন নিয়ে জন্মায়। বেড়ে ওঠে সুস্থভাবে। আমাদের দেশের একজন নারীর স্বাভাবিক অবস্থায় গড়ে প্রতিদিন ২০০০-২২০০ ক্যালরি প্রয়োজন। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ৩০০ ক্যালরি ও একজন স্তন্যদায়ী মায়ের প্রতিদিন ৭০০ ক্যালরি বাড়তি শক্তির প্রয়োজন হয়। স্তন্যদায়ী মায়ের এই বাড়তি শক্তির ৫০০ ক্যালরি তার প্রতিদিনের খাদ্য থেকে সংগৃহীত হয়। বাকি ২০০ ক্যালরি গর্ভাবস্থায় দেহে জমানো চর্বি থেকে তিনি পান। স্তন্যদায়ী মাকে তাই গর্ভাবস্থা থেকেই তার শিশুর জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়।

রক্তস্বল্পতা, আয়োডিনের অভাব, কিশোরী বয়সে মা হওয়া ইত্যাদি কারণে কম ওজনের শিশু, মৃত শিশু, বিকলাঙ্গ শিশু জন্মানোর ঝুঁকি থাকে। পুষ্টির অভাবে মা ও শিশুমৃত্যুর আশঙ্কাও বেশি থাকে। গর্ভবতী হওয়ার আগে ওজন ৪০ কেজির নিচে থাকলে প্রসবকালীন সময়ে কম ওজনের শিশুর জন্ম দিয়ে থাকে মা। গর্ভাবস্থার শেষ দিকে গর্ভের সন্তানের বৃদ্ধি বেশি হয়। এ সময় গর্ভবতী বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করলে গর্ভের সন্তানের পুষ্টি বৃদ্ধি ঘটে।

 কর্মজীবী নারীর গর্ভকালীন সময় আরো বাড়তি পুষ্টি ও সেবা প্রয়োজন। কারণ তার কর্মক্ষেত্রে বাড়তি পরিশ্রমে ক্যালরি খরচ হয়। এজন্য তাকে কিছুটা বাড়তি পুষ্টিকর খাবার দেয়া প্রয়োজন। পুষ্টিবিদদের মতে, একজন গর্ভবতী নারীর পুষ্টি তার শৈশব ও কৈশোরকালীন পুষ্টির ওপরও বহুলাংশে নির্ভর করে। একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী গর্ভবতী নারীই পারেন একটি সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুর জন্ম দিতে।

 একজন কর্মজীবী নারীকে গর্ভকালীন কর্মক্ষেত্রে অবশ্যই খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ভারি ওজনের কোনো কিছু বহন করা যাবে না। সিঁড়িতে ওঠানামার সময় খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ফ্ল্যাট জুতা পরতে হবে এবং দুঃশ্চিন্তা এড়িয়ে চলতে হবে। গর্ভের প্রথম তিন/চার মাস বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে। খারাপ লাগা, অস্থিরভাব যাই হোক না কেন, তা সাময়িক। সময়ের সাথে সাথে তা ঠিক হয়ে যায়। গর্ভবতী মাকে নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে, বিশেষ করে কর্মজীবী মায়েদের সহকর্মীদের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা খুব বেশি জরুরি।

মা হতে হলে নারীকে অনেক কষ্ট-যন্ত্রণা, ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে দশ মাস সময় অতিক্রম করতে হয় একটি শিশুর জন্ম দেখার জন্য। এই দীর্ঘ দশ মাস গর্ভবতী নারীর জীবন হয় ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে কর্মজীবী গর্ভবতী নারীর জীবন থাকে আরো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রাখা খুব জরুরি। যতটা না জরুরি নিজের জন্য, তার চেয়ে বেশি জরুরি অনাগত সন্তানের জন্য। মা ও গর্ভের শিশুর সু-স্বাস্থ্য নির্ভর করে মায়ের পুষ্টিকর খাবার, চলাফেরা, বিশ্রাম এবং পরিবেশের ওপর। মাতৃত্বের শুরু তথা গর্ভধারণের পর থেকে তার প্রয়োজন বিশেষ যতœ ও পরিচর্যার। খাবার-দাবার, হাঁটা-চলা ইত্যাদির বাইরে পোশাক-পরিচ্ছদের ওপরও যথেষ্ট নজর দেয়া প্রয়োজন। নজর দেয়া জরুরি গর্ভবতী মা’র প্রতিদিনের সাজ-সজ্জা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও।

 সন্তান ধারণ প্রত্যেক নারীর জন্য আনন্দের ও গর্বের। গর্ভধারণ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হলেও কখনও কখনও তা মারাত্মক হতে পারে। এ সময় হরমোনজনিত বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যার জন্য বিশেষ কিছু করার প্রয়োজন হয় না। সন্তান জন্মের পর এ সমস্যা ঠিক হয়ে যায়। তবে হরমোনজনিত পরিবর্তনের কারণে প্রসব পরবর্তী কোনো সমস্যা যদি স্থায়ী হয়, তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আর এসব বিষয়ে বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ খুবই আন্তরিক। সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর ভূমিকাও অত্যন্ত প্রশংসনীয় এ ক্ষেত্রে। গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবার উপর নির্ভর করে অনাগত সন্তানের সুস্থতা এবং ব্যাপক অর্থে সুস্থ ও আদর্শ জাতি গঠনের প্রথম ও অন্যতম প্রধান ধাপ।


লেখক: সহ-সম্পাদক, দৈনিক আমার যুগ।


সিটিজেন টাইমস্/সেলিনা আক্তা/ইয়ামিন