English

আমার বন্ধু চৌকিদার ইমান আলী

আমার বন্ধু চৌকিদার ইমান আলী
সোশ্যাল মিডিয়া

আমার বন্ধু ইমান আলী। পেশায় গ্রামপুলিশ, সাধারনভাবে যাদেরকে আমরা চৌকিদার বলে জানি। ইমান এবং আমি পাশাপাশি গ্রামের বাসিন্দা। আমার গ্রামের বাড়ী থেকে ওর ডেরার দূরত্ব কম বেশী এক কিলোমিটার। আমার প্রাইমারী স্কুল জীবন শুরু হয় আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম নিত্যানন্দকাঠি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ক্লাশ ওয়ান থেকে ফোর পর্য্যন্ত একসাথে পড়েছি আমরা। ক্লাশে বরাবরই ও ছিল আমার কমপিটিটর, কিন্তু শৈশবের ৪ বছরের সে বন্ধুত্ব আমরা বয়ে চলেছি প্রায় চার দশক ধরে।

দরিদ্র ঘরের সন্তান ইমান। বাবা ভূমিহীন। দারিদ্রে্র করালগ্রাসে ক্লাশে ফার্স্ট সেকেন্ড হলেও হাইস্কুলেই লেখাপড়ার ইতি ঘটে ইমানের। এরপর কখনো দিন মজুরি, কখনো সবজি বিক্রি কখনো এটা সেটা করে একসময় থিতু হয় গ্রাম পুলিশ বা চৌকিদার হিসাবে। মাথাগোজার কোন ঠাঁই নেই। নানী বাড়ীতে মায়ের প্রাপ্ত তিন চার শতক জমিতে কোন রকমে থাকে বউ বাচ্চা নিয়ে। সম্পদের মধ্যে আছে তিনটি ছেলে যার একজন রোগে ভুগে অকালে মারা গেছে, বাকী দুটির একজনের পড়াশুনা হয়নি,এখন এটাসেটা করে,ছোট ছেলেটি নবম শ্রেনীর ছাত্র। জীবন যুদ্ধে ওর তেমন কোন অর্জন নেই কিন্তু মুখভরা হাসিটি আছে।

দরিদ্র হলেও লাজুক প্রকৃতির আমার এ বন্ধুটির আত্মসম্মানজ্ঞান প্রখর। চালচুলোর ঠিক নেই কিন্তু যখনি বলেছি তোর জন্য এটা করি, ওটা করি, ছোট একটা দোকান করে দিই, একটা ঘর তুলে দিই বা একটা গরু কিনে দিই ও তখনি হাসিমুখে এড়িয়ে যায়। ওর একই কথা ,তুই তো আছিস, এখনো চলতে পারছি, যখন একেবারেই পারবোনা তখন না হয় করিস। কিছু নিলে পরে বন্ধু হিসাবে মনের মধ্যে যে সম্মান আর হাসিটুকু আছে সেটা তো আর থাকবেনা।

খালি তাই নয়, আমি যখনই বাড়ী যাই, খবর পেলেই চলে আসে, থানা ফাঁড়ির পুলিশের সাথে দিন রাত আমার বাড়ীতে ডিউটি করে কিন্তু পারতপক্ষে সামনে আসে না। আমি দেখতে পেলেই ঘরে ডাকি, খেতে বলি, সোফা বা ডাইনিং টেবিলে বসতে বলি, বসেনা, মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চলে যায়। ঘুম থেকে উঠেই দেখি আমাদের বাড়ীর সামনের মেহগনি বাগানে পুলিশের সাথে চেয়ার পেতে বসে আছে ইমান, দেখা করতে আসা লোকজনকে বাড়ীর লোকের মত করে চা নাস্তা খাওয়াচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই সামনে আসেনা।ওর জানার কথা, হয়তোবা জানেও যে, আমি তাকে বন্ধু হিসেবে মর্যাদা দিই, বাড়ীতে আমার সাথে দেখা করতে আসা সব ধরনের লোকের সাথে ইমান আলী কে বন্ধু হিসাবেই পরিচয় করিয়ে দিই। কিন্তু ও থাকে ওর মত, ফাঁড়ির কনস্টেবল, আমার সাথে দেখা করতে আসা সাধারন লোকজনের ভীড়েই।

ওর বাড়ীটি আমাদের এলাকার কয়েকটি গ্রামের মধ্যখানের সম্মিলনী ঈদগাহ্ সংলগ্ন। এই পড়ন্ত বয়সেও ঈদের আগের রাতে এলাকায় কিশোর তরুনদের সাথে মিলে রঙীন কাগজ কেটে, দেবদারুর পাতা দিয়ে, সূতায় ফিতা লাগিয়ে ঈদগাহ সাজায়, ঈদগাহে মুসল্লীদের দাঁড়ানোর জন্য চুন দিয়ে লাইন টানে, নামাজ শেষে মাথার টুপি খুলে মুসল্লীদের কাছ থেকে পয়সা তোলে ইমাম সাহেবের হাদিয়া এবং ঈদগাহের উন্নয়নের জন্য।

এমনিতেই ইমানের সাথে আমার কথাবার্তা খুব একটা হয়না, আমিই মাঝে মাঝে ফোন করি। ওকে বলি ফোন করিস, যোগাযোগ রাখিস। এ জগতে ওর তেমন কিছু না থাকলেও চমৎকার একটি হাসি আছে। সেই হাসিটুকু দিয়েই বলে তুমরা ব্যস্ত মানুষ, কখন ক্যামনে থাকো? এজন্য আর ডিস্টাপ দিইনা।

বাড়ীতে গেলে প্রায় প্রতিদিন সকালেই ইমান আসে। সাথে থাকে ওর সর্বক্ষনের সাথী একটি বাইসাইকেল। আমি আমার বন্ধু ইমান কে সাথে নিয়ে গ্রামের স্কুলমাঠ,ঈদগাহ, কবর স্থান, খেলার মাঠে যাই, ডিপ টিউবওয়েলের ড্রেনের উপর বসে সুখ দুঃখের গল্প করি অকপটে।ও মুখচোরা টাইপের মানুষ,কথা খুব কম বলে।কষ্টদুঃখের কথা বলতেই চায়না।খুব পীড়াপীড়ি করলে বলে বোঝোইতো চৌকিদারের চাকরি হচ্ছে একবিটির তিন স্বামী ,ইউএনও/ ওসি/ চেয়ারম্যান,সবাইরে খুশী রাখা কঠিন,আবার বেতন দিনে মাত্র দুশো টাকা!!

আজ সকালেই ইমানকে ফোন করলাম, এমনি খোঁজ খবর নেবার জন্য। ফোন করতেই বললো কদিন তোর কতাই ভাবছিলাম, গাছে গুড়াইত আম হয়েছে,ভাবছিলাম তোর বাসায় পাঠাই দি, বাইল বাইচ্চা খেবানি। আমি লজ্জা পেলাম। আমার তো একবারও মনে হয়নি আমার বন্ধু ইমান গরীব মানুষ, ওর জন্য কিছু আম পাঠিয়ে দি। ওকে বললাম, ধন্যবাদ দোস্ত,লাগবেনা, তোর বাচ্চাদের খাওয়াস।

ও সত্যিকারের ভূমিহীন। ওর এবং ওর বাবার এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। যেখানে থাকে সেটা ওর নানার তরফ থেকে পাওয়া ওর মায়ের সম্পত্তি। ওকে একবার বললাম সরকার ভূমিহীনদের ঘর করে দিচ্ছে, কাউকে বলে তোরে একটা ঘরের ব্যবস্থা করি? ও স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললো আমার তো তাও ছোট হলেও একটা চাকরি আছি, গায়ে গতরে খেটে দুবেলা দুমুঠো খাতি পারি, অনেকের তাও নেই, তারাই পাক, আমার লাগবেনা। আর তা ছাড়া ছোট কালতে ইকেনে থাকি ,একন আবার কনে যাব? এই হল আমার বন্ধু ইমান, নির্লোভ, সৎ এবং অসম্ভব বন্ধুবৎসল।

এমনিতেই ইমান আমাকে কখনো ফোনও করেনা সাধারনত। কিন্তু আমি যখন করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলাম প্রায় ই আমাকে এসএমএস দিত, আমার ব্যক্তিগত স্টাফদেরকে ফোন করে নিয়মিত খোঁজ খবর নিতো। কিন্তু ওর যে বাচ্চাটা অসুস্থ্য হয়ে মারা গিয়েছে তার অসুস্থ্যতার খবর কিন্তু ও আমাকে প্রথমেই দেয়নি। লোক মুখে জেনে যখন ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছি তখন ও বললো ছাগল গরু যা ছিল বেঁচে দিছি, ছেলেটার চিকিৎসা করাচ্ছি, তোরে বলিনি কারন জানলিই তো তুই টাকা পাঠাবি। যতক্ষন পারি ততক্ষন নিজে করি, না পারলি তো তোরে বলবোই ।ইমানের এবং আমাদের সকলের সব চেষ্টা বৃথা করে যখন ওর বাচ্চাটি মারা যায় সেই একদিনই আমি ওর কন্ঠে আক্ষেপ শুনেছি। ও চিৎকার করে ওর দারিদ্র্যকে অভিশাপ দিয়েছে।

অসম্ভব মেধাবী, মানবিক এবং আত্মসম্মান জ্ঞানসম্পন্ন ইমানের অবস্থান আমার কাছে আমার অনেক বন্ধুরই অনেক উপরে। আমার সব সময়ই মনে হয় যদি সত্যিই কখনো কোন প্রয়োজন হয় ইমান এবং ইমানের মত কিছু বন্ধুই পাশে থাকবে।

ওর আর একটা রেয়ার গুন হল আমার বন্ধু হিসাবে পরিচয় দিয়ে কারো কাছ থেকে কোন বাড়তি ফেভারও নেয়না এমনকি পরিচয় দিয়েও বেড়ায়না।

চরম দারিদ্র্য না থাকলে ইমানের যে মেধা, সততা এবং পরিশ্রমী মানসিকতা ছিল তাতে ওর পক্ষে অনেক কিছুই হওয়া অসম্ভব ছিলনা।হতে যে পারেনি তাতে ওর কোন দুঃখ আছে বলে মনে হয়না।সব সময়ই ওর মুখে একটা তৃপ্তির হাসি।

আজও ওকে জিজ্ঞেস করলাম তোর জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করি? ও বললো বাপের আমলের মাটির ঘরখান এখনো আছে, ভাঙাচুরো হলিও খুব ঠান্ডা আর আরাম। দরকার নেই নতুন ঘরের। দরকার হলে তো তোরে বলবোই। যদিও আমি জানি ইমান কখনোই কিছু বলবেনা, কখনোই আমার কাছে কিছু চাইবেনা।

এভাবেই হয়তো অভাব অনটন কে সংগী  করে ,খেয়ে না খেয়ে জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ,মুখের এক চিলতে হাসিটুকু নিয়ে ও একদিন পৃথিবী থেকে চলে যাবে।

ইমান ফেসবুক ব্যবহার করেনা, মোবাইল ডাটার চেয়ে চাল ডাল কেনা ওর জন্য বেশী জরুরী। ওকে নিয়ে আমার অনুভূতি  হয়তোবা ও কখনোই জানতে পারবেনা। ও না জানুক, না বুঝুক, তবুও লিখলাম। লিখতে লিখতে বার বার খালি মনে হচ্ছিল মানুষের বেশীর ভাগ সত্যিকারের অনুরাগই অব্যক্ত থেকে যায়। ব্যক্ত করতে পারার মধ্যেও এক ধরনের সূক্ষ্ম সুখবোধ আছে, সেটুকু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছে হলনা।

আজো ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর জন্য একটা চাকরি বাকরি দেখবো? ঢাকায়? ছোটখাটো একটা চাকরির ব্যবস্হা হলেওতো ১৫/২০ হাজার টাকা খুব কঠিন কিছুনা। ইমান ওর স্বভাব সুলভ হাসিটুকু দিয়ে বললো, না থাকগে,দোস্ত, বাড়ীত থাকি, বউ বাচ্চার মুখ দেকতি পারি, খেয়ে পরে দিন তো খারাপ যেতেছনা।

বুঝলাম দারিদ্র্য আর অভাব ওর অনেক কিছু কেড়ে নিলেও সুখটুকু পুরোপুরি নিয়ে নিতে পারেনি এখনো। ভাবলাম ও যেখানে যেভাবেই আছে থাকুক, সুখেই তো আছে। ওর সুখের অসুখ বাধানো কি দরকার?

আমার বন্ধু চৌকিদার ইমান আলীর জন্য আমার এক সাগর ভালবাসা । ফেসবুক ওয়াল থেকে ।



লেখক: মো: মনিরুজ্জামান, ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ ।