আন্তর্জাতিক ডেস্ক
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চাঞ্চল্যকর হাজার কোটি
টাকা লোপাট মামলার মূল অভিযুক্ত ও পলাতক আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার)
বাংলাদেশে হস্তান্তর করা হবে। ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) কর্মকর্তারা এই ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির
ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ।
তারা বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ২০১৬
সালের প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় পি কে হালদারকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর
করা হবে। ইডির একজন কর্মকর্তা দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছেন, আমরা হালদারকে রোববার আদালতে
তুলবো। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হবে।
শনিবার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর থেকে
গ্রেপ্তারের পর বাংলাদেশের হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ মামলার মূলহোতা পি কে হালদারকে
ভারতের একটি আদালতে তোলা হয়। পরে আদালতের বিচারকরা তাকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ইডি হেফাজতে
পাঠিয়ে দেন।
পি কে হালদার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স
ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই দুই প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরও কয়েকটি
প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)
তদন্ত শুরু করার পর তিনি কানাডায় পালিয়ে যান বলে ধারণা করা হয়েছিল।
শুক্রবার দিনভর কলকাতা ও উত্তর চব্বিশ পরগনার অন্তত
৯টি স্থানে অভিযান চালায় ইডি। সেসময় উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার
পোলেরহাটে দু’টি বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় পি কে হালদারের ব্যক্তিগত
আইনজীবী সুকুমার মৃধার অবৈধ সম্পত্তির খোঁজে অভিযান শুরু করে ভারতের এই সংস্থা। কর্মকর্তারা
বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এই তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করেন।
বিপুল
সম্পদের খোঁজ
পরে শনিবার পি কে হালদারের সম্পত্তির খোঁজে দ্বিতীয়
দফায় আবারও অভিযান শুরু করে দেশটির আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। সেই অভিযানে উত্তর চব্বিশ পরগনার
অশোকনগরের একটি বাড়ি থেকে পাঁচ সহযোগীসহ পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের
পাশাপাশি ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত মুম্বাই এবং রাজধানী দিল্লিতেও অভিযান চালায়
ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী এই সংস্থা।
ইডি বলেছে, ব্যক্তিগত আইনজীবী সুকুমার মৃধার সহায়তায়
পি কে হালদার পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের একাধিক রাজ্যে বিপুল সম্পদ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে
অবৈধভাবে অর্থপাচারের মাধ্যমে ভারতে একাধিক অভিজাত বাড়িসহ বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন
বলে খোঁজ পেয়েছে ইডি।
ইডির সূত্র বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন
ভুয়া কোম্পানির নামে বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নেন হালদার এবং সেই অর্থ তিনি ভারতে
পাচার করেন। ইডির একজন কর্মকর্তা টেলিগ্রাফকে বলেছেন, হালদারের এসব কোম্পানির কোনও
অস্তিত্ব নেই। পরবর্তীতে ব্যাংকগুলো হালদারের প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারে এবং বাংলাদেশের
আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে অভিযোগ দায়ের করে। পরে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের অনুরোধে
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে ইডি। দেশটির কেন্দ্রীয় এই তদন্ত সংস্থা বলছে, তারা অভিযানের
সময় পি কে হালদারের কাছ থেকে সম্পত্তি এবং জমির দলিলসহ কিছু মূল কাগজপত্র জব্দ করেছেন।
এসব নথিতে প্রাথমিকভাবে ভারতে তার ২০ থেকে ২২টির মতো বাড়ির মালিকানার তথ্য মিলেছে।
বেনাপোল-পেট্রাপোল
সীমান্ত দিয়ে ২০১৯ সালে ভারতে যান পি কে হালদার
হালদার ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেনাপোল-পেট্রাপোল
সীমান্ত দিয়ে ভারতে পৌঁছান বলে সংস্থাটি জানতে পারে। ভুয়া ভারতীয় ভোটার, প্যান এবং
আধার কার্ড সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। শিব শঙ্কর হালদার নামে উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগরে
বিপুল সম্পত্তি গড়েছেন তিনি। ইডির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তার সহযোগীরাও একই ধরনের
ভুয়া ভারতীয় ভোটার, প্যান ও আধার কার্ড সংগ্রহ করে অশোকনগরে নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা
করছিলেন।
ভারতীয় এই গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন,
পি কে হালদারকে বাংলাদেশে হস্তান্তরের পেছনে দুটি বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, বাংলাদেশের
আর্থিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধ, অন্যটি তার বিরুদ্ধে
যেসব মামলা রয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট।
এর আগে ইডির এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশি নাগরিক
প্রশান্ত কুমার হালদার, প্রীতিশ কুমার হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার এবং তাদের সহযোগীদের
বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। প্রশান্ত কুমার হালদার নিজেকে শিব শঙ্কর হালদার
নামে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন।
হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, বাংলাদেশি এই নাগরিকরা
প্রতারণার মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসায়িক কোম্পানি চালু
করেন। কোম্পানি পরিচালনার পাশাপাশি কলকাতা মেট্রোপলিটন এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে স্থাবর
সম্পত্তি কিনেছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইডির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, পি কে হালদারের
ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ব্যক্তিগত আইনজীবী সুকুমার মৃধার অন্তত তিনটি বাড়ি রয়েছে অশোকনগরে।
এই এলাকায় তিনি মাছ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।
এর আগে, দুর্নীতি দমন কমিশন ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি
পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, পলাতক পি কে হালদার তার নামে অবৈধ উপায়ে এবং ভুয়া কোম্পানি
ও ব্যক্তির নামে প্রায় ৪২৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন।
অবৈধ সম্পদের অবস্থান গোপন করতে ১৭৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের
মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করেন পি কে হালদার। তিনি এসব অ্যাকাউন্টে ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা
জমা রাখেন। পাশাপাশি এসব অ্যাকাউন্ট থেকে তার নামে ও বেনামে আরও ৬ হাজার ৭৬ কোটি টাকা
উত্তোলন করেন। দুদকের তথ্য বলছে, পি কে হালদার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১১ হাজার
কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।